আন্তর্জাতিক ডেস্ক
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার বিশাল মরু অঞ্চলের নগর আর শহরগুলোতে চলছে আল কায়দার আধুনিক সংস্করণ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামি স্টেটের শাসন। যদিও পশ্চিমা মিডিয়ার কল্যাণে শিরশ্ছেদসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক দুর্নাম কুড়িয়েছে এ গোষ্ঠীটি। তবে তারা কেবল লড়াই আর হত্যাই করে না, প্রশাসনিক কাজেও দক্ষতার ছাপ রেখেচলেছে তারা। তাদের বিভিন্ন গঠনমূলক কাজ নিয়ে দীর্ঘ এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দা ইন্ডিপেন্ডেন্।
সিরিয়ার আর-রাক্কাহ প্রদেশের সরকার পরিচালনা করছে ‘ইসলামি স্টেট অব ইরাক এন্ড দা লেভেন্ত’ গোষ্ঠীটি।যেমন শহরবাসীর জন্য বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করা, বেতন দেয়া, ব্যস্ত সড়কগুলোতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। এককথায় বলতে গেলে সেখানকার বেকারি থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক বীমা, আদালত, স্কুল এবং মসজিদ সবকিছুই তারা নিপুন হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এসব পরিচালনা করছে ইসলামি আইনের আলোকে।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আর রাক্কাহ প্রদেশ ইসলামি স্টেটের শাসন পদ্ধতির একটি উৎকৃষ্ট চিত্র। আইএস সদস্যরা প্রদেশটির জীবন ব্যবস্থাকে ইসলামি খিলাফতের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে দাবি করে থাকেন এবং এরই আদলে একদিন চীন থেকে শুরু করে গোটা ইউরোপ শাসন করার স্বপ্ন দেখছে তারা।
প্রদেশের ধুলো ধূসরিত রাজধানী রাক্কাতে ২৫ হাজার লোকের বাস। গত তিন বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে এখানকার লোক সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেছে। এখানে এখন এমন একটি প্রতিষ্ঠানও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে আইএসের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সম্পর্কে রাক্কার এক সমাজকর্মী বলেন, তারা ব্যাপক সাংগঠনিক কাজ করেছে।
দলের প্রধান নেতা আবু বকর বাগদাদির নিয়ন্ত্রণে গত এক বছর ধরে শহরের নির্মাণ কাজ শুরু করেছে আইএস যা বর্তমানের আধুনিক সরকারের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা যায়।
রাক্কায় তাদের এই অগ্রগতি মধ্রপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাদেরকে ‘ক্যান্সার’ হিসেবে উল্লেখ করে মধ্রপ্রাচ্য থেকে তাদের উৎখাতের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মার্কিন বোমারু বিমানগুলো ইতিমধ্যে ইরাকে আইএসের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করেছে। তবে ইরাকের মত রাক্কায় বিমান হামলা চালানো অত সহজ নয়।
গত বছর রাক্কাই হচ্ছে প্রথম শহর, যা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছিল। তাই এই শহরটিকে বিদ্রোহীরা ‘বিপ্লবের কনে’(ব্রাইড অব রেভ্যুলেশন) বলে অভিহিত করে থাকে। এখানে চরমপন্থি থেকে শুরু করে মধ্যপন্থি বিদ্রোহীরা অবস্থান করছে। তবে শহরের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেআইএস। গত এক বছর ধরে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করে শহরের গোটা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে।
আইএসের বিরোধিতাকারীদের হয় হত্যা করা হয়েছে, অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন, কেইবা পালিয়ে গেছে প্রতিবেশী তুরস্কে। শহরে মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। দোকানগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় এবং রাতে রাস্তাঘাট থাকে নিরব ও জনশূণ্য। এখানকার বাসিন্দাদের বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। একমাত্র আইসিস সদস্যদের বাইরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার অধিকার রয়েছে।
এখানকার বিদ্রোহী বা কর্মীরা বাগদাদির করুণার ওপর বেঁচে রয়েছেন। আইএসের বিরুদ্ধে কোনো রকম অপরাধের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। তাই হয় তারা নিজেদের ঘরে আবদ্ধ থাকে বা জঙ্গি গোষ্ঠিতে যোগ দেয়। এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই তাদের।
তবে গত এক বছরে শহরবাসীর জন্য বেশ কিছু চাকুরি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেছে আইএস। তবে এগুলো এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা আইএসের ঘাঁটি বলে ভ্রম হয়। এজন্য রাক্কার এক নাগরিক বলেন,‘ শহরের যেসব লোকজন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয় তারা সহজেই ইসলামি স্টেটের এই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। কেননা দীর্ঘ লড়াইয়ে তার ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত।’
রাক্কায় এখন স্কুল-কলেজ, বিচারালয়, বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই আইএসর কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গত মাসে মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফোলে ও স্টেভেন সটলোফ ছাড়াও বেশ কয়েকজন কুর্দি ও লেবাননি বন্দিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল আইএস। তাই বলে তারা নির্বাচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এমনটি বলা যাবে না। তারা প্রায়ই আসাদের অনুগত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। একজন যোদ্ধা জানান, আসাদের সাবেক এক কর্মচারী এখন রাক্কার বেকারিগুলোতে দুধ এবং ময়দার যোগান দিচ্ছেন।
উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপসহ বাইরের বেশ কিছু দেশের বিশেষজ্ঞরা এই গোষ্ঠিটিকে নানাভাবে সহায়তা করে থাকে। রাক্কার টেলি যোগাযোগ খাতে একজন টিউনেশিয়কে নিয়োগ দিয়েছেন বাগদাদি। ওই ব্যক্তি টেলি কমুনিকেশন বিষয়ে পিএইডি করা।
বাগদাদির সামরিক শাখাটি বেসামরিক প্রসাশনের চেয়ে একেবারে পৃথক। প্রশাসনের জন্য নিয়োগকৃত বেসামরিক কর্মকর্তাদের বলা হয় ‘ওয়ালি’। ওয়ালিদের দায়িত্ব অনেকটা আধুনিক যুগের মন্ত্রীদের মত।
প্রসাশনিকভাবে ওই অঞ্চলটিকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং এসব অঞ্চল ‘ওয়ালিয়েস’ নামে পরিচিত।এরখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সেনাদের নিয়মিত বেতন দেয়া হয়ে থাকে। যে বিভাগটি প্রশাসনের আর্থিক বিষয়টি দেখভাল করছে তাকে বলা হয় ‘মুসলিম ফিনান্সিয়াল হাউস। এর কাজ অনেকটা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাঙ্কের মত।
আইএসের এক যোদ্ধ জানান, শহরের দরিদ্র মানুষদের নানাভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। একজন বিধবা নারী ৬০ ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন। তার সন্তানদেরও নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।শহরের জিনিসপত্রে দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যেসব ব্যবসায়ীরা কৃত্তিমভাবে দাম বাড়িয়ে থাকেন তাদের জন্য রয়েছে নানারকম শাস্তির ব্যবস্থা।
গোষ্ঠিটি ইসলামি আইনানুযায়ী অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী ও পরিবারের কাছ থেকে কর আদায় করে থাকে। এ সম্পর্কে রাক্কার এক জিহাদি বলেন,‘আমরা কেবল ইসলামি আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। জাকাত হচ্ছে এমন একটি কর যা আল্লহ কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে।’
আইসিসের শাসন ব্যবস্থ আবর্তিত হচ্ছে বাগদাদিকে কেন্দ্র করে যিনি গত জুন মাসে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা বা শাসনকর্তা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। রাক্কা প্রসাশনের প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় তিনি নিজে দেখাশোনা করে থাকেন। এমনকি একটি পণ্যের দাম ঠিক করার আগে কিংবা একজন অপরাধীদের দণ্ড নির্ধারণের আগে তার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়ে থাকে।
বাগদাদি নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে বাইরের দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। তিনি বাইরের দেশগুলোর জিহাদি এবং বিশেষজ্ঞদের গোষ্ঠির প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে চেযেছিলেন। তার সে চেষ্টা সফল হয়েছে বলতে হবে। কেননা এরই মধ্যে অনেকেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তার খিলাফতকে সহায়তা করার জন্য বিশ্বের ধনী মুসলমানরা রাক্কায় অর্থ পাঠিাতে শুরু করেছে।
রাক্কা থেকে প্রাপ্ত সূত্র মতে, এখানে তিনটি অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে যেগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ কাজে বেশ কিছু বিদেশি বিশেষজ্ঞ যুক্ত হয়েছেন যারা কড়া প্রহড়ায় একটি গোপন স্থানে অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে বেশ কিছু চীনা মুসলিম রয়েছে বলেও জানা গেছে। এক আরব জিহাদি বলেন,‘বিজ্ঞানী এবং ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরা স্টেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’
এখানেই শেষ নয়, তাদের ধ্যান ধারণা বহণকারী একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির কাজও হাতে নিয়েছে আইএস। এ জন্য তারা শিশুদের মধ্যে নিজেদের ধারণা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। এছাড়া আগ্রহী নারীদেরকেও তারা নিজেদের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করছে। এসব নতুন যোদ্ধাদের ‘প্রকৃত ইসলাম’ শিক্ষা দিতে রাক্কার মসজিদে সমবেত হন শিক্ষক গোষ্ঠি। এ সম্পর্কে এক আরব জিহাদি বলেন,‘তিন দিন অন্তর প্রায় এক হাজার নতুন যোদ্ধা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা তাদের আমাদের আদর্শে উজ্জীবিত করে তুলি।’