সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষক পণ্ডিত রামকানাই দাশ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
সিলেট অঞ্চলের বাউল গুরু কামাল পাশার স্মৃতিকে সংরক্ষিত করার জন্য সুনামগঞ্জে ‘কামাল পাশা স্মৃতি সংসদ’ গঠন করা হয়। আর তিনি ছিলেন তার আজীবন উপদেষ্ঠা মণ্ডলির সদস্য। তিনি তার সিলেটের করেরপাড়াস্থ বাসভবনে বসে ‘কামাল পাশা স্মৃতি সংসদ’ গঠনের ব্যাপারে সবাইকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন।
প্রথম জীবনে ভাটি অঞ্চলে কবিগানের প্রচার ও প্রসার এবং পরবর্তীতে শাস্ত্রীয় সংগীতের দীক্ষা দিয়ে পণ্ডিত রামকানাই দাশ এদেশের সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বাউল গুরু কামাল পাশার গান নিয়ে রামকানাই দাশ অনেক গবেষণা করেছেন। তাই তিনি তার সম্পর্কে বলেন, ‘সেইসব শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান যারা ওস্তাদ কামাল পাশার মতো উচ্চ শিক্ষিত বাউল শিল্পীর গান শুনেছেন। এবং যারা কামালের গান শুনেনি ও চর্চা করেনি তাদের মতো হতভাগা আর সঙ্গীত জগতে নেই।’
তিনি নেত্রকোনার জালাল কবির নামে ‘জালালগীতি’ বইয়ে প্রকাশিত কয়েকটি গানের উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই গানগুলি আমি নিজে কামাল সাহেবকে গাইতে দেখেছি’।
আল-হেলাল প্রকাশিত গানের সম্রাট কামাল পাশা ক্রোড়পত্র হাতে নিয়ে তিনি আরও বলেছেন, আসলেই কামাল পাশা গানের সম্রাট ছিলেন। উপস্থিত মুহূর্তে যেকোনো বিষয়ে তাৎক্ষীণকভাবে রচনা করে গান গাওয়ার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী শিল্পীর নামই কামাল পাশা।’ পণ্ডিত রামকানাই বাউল কামাল পাশার গান সংগ্রহ ও প্রকাশনার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছেন। তাই আমরা তার কাছে বিশেষভাবে চিরঋণী।
২০০৮ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে সাংবাদিক আল-হেলাল সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘গানের সম্রাট কামাল উদ্দিন’ গীতিগ্রন্থে সর্বপ্রথম সঙ্গীত প্রতিভা রামকানাই দাশের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়।
এতে উল্লেখ করা হয়, নরসিংদীর হরি আচার্য্য কবিগানের স্রষ্টা ছিলেন। দিরাই থানার কামিনী দাস, হরিচরণ দাস সরকার ও অধর চন্দ্র ঠাকুর এই তিন রত্নকে কবিগানের সরকার বলা হতো। পেরুয়া গ্রামের ওস্তাদ রামকানাই দাস কবিগানের শেষ গায়ক।
হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা নিবাসী কালী মোহন চক্রবর্ত্তীর কাছ থেকে রামকানাই দাস কবি গানের পদ্ধতিগত তালিম নেন। তার স্বর্গীয়া মা শাল্লা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের দিব্যময়ী দাস ও স্বর্গীয় বাবা দিরাই উপজেলার পেরুয়া নিবাসী রশিক লাল দাস জুটি জীবদ্দশায় কবি গানের পালা গান গাইতেন। তাদের মেয়ে সুষমা দাস একজন আঞ্চলিক কবি গানের শিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। রামকানাই দাসের স্ত্রী অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকার ড. সঞ্জিদা খাতুনের স্কুলের শিক্ষিকা। যিনি কলকাতার মশকুর আলী সাহেবের কাছে তালিম নেন। তাদের মেয়ে কাবেরী দাস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় ত্রিমূর্তি সঙ্গীত কলেজের অধ্যাপিকা। জ্যেষ্ঠ ছেলে অরুণ চন্দ্র দাস একজন শিল্পী ও ছেলে পিনু সেন দাস জনপ্রিয় তবলা বাদক।
১৯৬৫ সালে দিরাই উপজেলার শ্যামারচর বাজারে পরবর্তীতে সদর উপজেলার পাগলা বাজারে গানের সম্রাট কামাল উদ্দিনের সঙ্গে ওস্তাদ রামকানাই দাস প্রথমবারের মতো কবিগানের আসরে পালাগান পরিবেশন করেন।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামের কৃতি সন্তান ওস্তাদ রামকানাই দাশ গত ২৬ আগস্ট মঙ্গলবার মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে সিলেটের করেরপাড়াস্থ বাসভবনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে রাতে তাকে সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন তাকে সিলেট থেকে ঢাকায় নিয়ে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিউরো সার্জন ডা. রসিদ উদ্দিন, কনক কান্তি বড়ুয়ার ও আফজালুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে তার চিকিৎসা চলে। সর্বশেষে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাকে। ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর শুক্রবার রাতে সাড়ে ১০টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সঙ্গীত জগতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পণ্ডিত রামকানাই দাশ ২০১৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
‘দ্বীন দুনিয়ার মালিক খোদা, এতো কষ্ট সয়না, তোমার দিল কী দয়া হয়না’, ও ‘প্রেমের মরা জলে ডোবেনা’সহ হাজার হাজার তত্ত্ব গানের রচয়িতা বাংলাদেশের মরমী সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র মরহুম বাউল কামাল পাশাসহ অনেক অগ্রজ শিল্পীদের সঙ্গীতকর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। দেশ বিদেশে অগনিত ছাত্রছাত্রী রয়েছে তার।