নিজস্ব প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) মামলাটি ছিল বেশ আলোচিত। বিচার চলাকালে নানান মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় ছিলেন তিনি। বিচারকের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, কারারক্ষীদের সঙ্গে অকথ্য আচরণ, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা, আইনজীবীকে বাদ দিয়ে নিজেই মামলা পরিচালনাসহ বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তবে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর থেকে কাশিমপুরের নিভৃত কারাগারে আচার-আচরণ ও মেজাজ-মর্জিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এই বিএনপি নেতার।
কাশিমপুর কারাগারের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে যেমন উত্তেজিত মেজাজে চলতেন, সেই মেজাজে এখন আর তাকে দেখা যায় না। রায় ঘোষণার পর থেকেই তিনি গতানুগতিক ঠাণ্ডা মেজাজেই সময় পার করছেন।’
‘প্রতিদিন নিয়ম করে পত্রিকা পড়া, বই পড়া এখন তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি নামাজ ও কোরআন শরীফ পড়ে সময় কাটাচ্ছেন।’
অতীতে সাকা চৌধুরী কারারক্ষীদের সঙ্গে অকথ্য আচরণ করলেও এখন আর তিনি অভ্যন্তরীণ কারারক্ষীদের সঙ্গে বকা-ঝকার সুরে কথা বলেন না। তার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসায় তাকে নিয়ে কারারক্ষীরা এখন অনেকটাই শঙ্কামুক্ত। শারিরীকভাবে সুস্থও রয়েছেন তিনি। প্রতি মাসে নিয়ম করে পরিবারের লোকজন দেখা করে আসেন তার সঙ্গে। এ মাসের (জানুয়ারি) শুরুতেই সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা গিয়ে দেখা করে এসেছেন তার সঙ্গে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাশিমপুর কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল বলেন, ‘যতদূর জেনেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাগারে ভালো আছেন। খাওয়া, চলা-ফেরায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। তিনি আগের মতো শক্ত মেজাজে নেই বলে শুনেছি। নতুন জেলার হিসেবে সদ্য নিয়োগ পেয়ে এখানে এসেছি। তাই এখনো তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি ভালোই আছেন।’
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিএনপির এই নেতার মামলাটি ছিল ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত মামলা।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই রায় দেন। রায়টি ছিল ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৃতীয় রায়। কোনো বিএনপি নেতার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হিসেবে এটিই ছিল প্রথম।
ট্রাইব্যুনালের এই রায়ে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত অভিযোগগুলো ছিল ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ১৭ ও ১৮। এর মধ্যে ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এ ছাড়া ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে ৬০ বছর এবং ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছর করে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এর আগে ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই বছরের ১৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ১৭ নভেম্বর তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ তার বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। ওই বছরের ১৪ মে এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এরপর দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস ধরে চলা সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ২৪ জুলাই। এ সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ৪১ জন ও আসামিপক্ষে চারজন।
দুই পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গত ২৮ জুলাই যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। সাকা চৌধুরীকে অপরাধী দাবি করে সর্বোচ্চ সাজার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি এবং তাকে নিরাপরাধ দাবি করে খালাসের জন্য আসামিপক্ষের পাল্টা যুক্তি শেষ হয় গত ১৪ আগস্ট। এভাবে সুদীর্ঘ আড়াই বছরেরও বেশি সময় বিচারকার্য শেষে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।