ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
নানান কারণে অনেক মানুষই আজকাল ইউরিনারি ট্র্যাক্ট বা প্রস্রাবের সমস্যায় ভুগেন। এর কিডনিতে স্টোন হওয়া থেকে একাধিক ইস্যুতে হতে পারে এই সমস্যা। আর এর থেকে দেখা দিতে পারে ভয়ঙ্কর রোগ। বিশেষভাবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই সমস্যার হার বেশি। বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ডা. এম এম মাজেদ তাঁর কলামে লিখেন, আমাদের মাঝে অনেকেরই প্রস্রাবজনিত নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রস্রাবের সমস্যাগুলো হচ্ছে- প্রস্রাবে কষ্ট, জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাব ধারণে অক্ষমতা, প্রস্রাবকালীন ঝরা এবং বিছানায় প্রস্রাব ইত্যাদি। প্রত্যেক ধরনের সমস্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। আর চিকিৎসার পূর্বে অবশ্যই কারণ জানা দরকার। তা না হলে সঠিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করা হবে না। প্রথমে আলোচনা করছি প্রস্রাবে কেন কষ্ট ও জ্বালাপোড়া হয় এ সম্পর্কে। আমাদের দেহের প্রস্রাব ধারণের যে আধার রয়েছে, যাকে কিনা মূত্রথলি বলা হয়ে থাকে। কোনো কারণে যদি এর সম্প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায়, তখনই ঘন ঘন প্রস্রাব, ঘুমের মাঝে প্রস্রাব এবং দ্রুত প্রস্রাবের বেগ চাপা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। মূত্রথলির সম্প্রসারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে- মূত্রথলির প্রদাহ; যা কিনা ইনফেকশন, রেডিয়েশন, কেমিক্যাল প্রয়োগ, ক্যাথেটার প্রয়োগ করানো, পাথর জমা ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। যদি মূত্রনালির মাংসগাত্রে টিউমার বিস্তার লাভ করে কিংবা সংলগ্ন অঙ্গ যেমন প্রস্টেটগ্রন্থি, মলনালি, জরায়ু ইত্যাদির টিউমারের বিস্তারের কারণে প্রস্রাবকালীন কষ্ট বেশি করে দেখা দিতে পারে। সমস্যাগুলো কারো হয়তো বার্ধক্যজনিত কারণে হচ্ছে, কারো ক্ষেত্রে বিভিন্ন রোগব্যাধির কারণে রয়েছে আবার কারো হয়তো মানসিক সমস্যার কারণে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। প্রস্রাবের রঙ দেখে জেনে নিন আপনি কোন রোগে আক্রান্ত! ইদানিং কোনো কারণে ডাক্তারের কাছে গেলেই অন্যান্য অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার সাথে ডাক্তার কিন্তু আপনাকে প্রস্রাব বা ইউরিন টেস্টও দিয়ে থাকেন। এটি কিন্তু অযথা নয় বরং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আপনার দেহের নানা পরিবর্তন বা অসুখের বিষয় ধরা পড়ে আপনার প্রস্রাবের পরীক্ষার মাধ্যমেই। আর আপনি নিজেও কিন্তু ঘরে বসেই জেনে নিতে পারেন অনেক অসুখের অগ্রিম বার্তা। কীভাবে? আপনার প্রস্রাবের রঙ দেখে। দেখে নিন আপনার প্রস্রাবের রঙ কেমন হলে আপনি কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
প্রসাবের বিভিন্ন বর্ণঃ * স্বচ্ছ/সাদা* হালকা হলুদ
* গাঢ় হলুদ * বাদামী বা কালচে বাদামী * গোলাপী বা লালচে * ফেনাযুক্ত প্রস্রাব
* ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মূত্রথলিতে ইনফেকশন
* মানসিক সমস্যা * প্রস্রাবকালীন জ্বালাপোড়া
* প্রস্রাব ধারণের অক্ষমতা * প্রতিরোধ * শেষ কথা * স্বচ্ছ/সাদা আপনার প্রস্রাব যদি হয় স্বচ্ছ বা সাদা পানির মতন তবে আপনাকে সুস্থই বলা চলে। দেহে জলশূন্যতা নেই। সুতরাং যে পরিমাণ পানি পান করছেন তা আপনার সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে কাজে দিচ্ছে বলাই বাহুল্য!
* হালকা হলুদ-এটি ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে দেহ থেকে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থগুলো বেরিয়ে যাবার জন্যে আরো খানিকটা পানি প্রতিদিন খাবার দরকার আছে আপনার।
* গাঢ় হলুদ-এর অর্থ আপনার শরীর যথেষ্ট জল পাচ্ছে না। আপনার দেহের জলশূন্যতা রোধে দ্রুত যথেষ্ট পানি পান করা প্রয়োজন।
* বাদামী বা কালচে বাদামী-আপনার প্রস্রাবের রঙ যদি হয় বাদামী বা কালচে বাদামী রঙের তাহলে বুঝতে হবে আপনি হয়তো লিভারের রোগে আক্রান্ত। অথবা চরম মাত্রার জলশুন্যতাও এর আরেকটি কারণ হতে পারে। দ্রুত ডাক্তার দেখান।* গোলাপী বা লালচে-
আপনি যদি সম্প্রতি জাম বা বিট জাতীয় ফল না খেয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে আপনার প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাচ্ছে। এর নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন, কিডনির সমস্যা, মূত্রনালীর সংক্রমণ, টিউমার বা প্রোস্টেটের সমস্যা।* ফেনাযুক্ত প্রস্রাব সাধারনত কিডনির সমস্যার কারণে ফেনাযুক্ত প্রস্বাব হতে থাকে। এটি যদি নিয়মিত হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। প্রস্রাবের রঙ দেখে মূলত আপনার দেহের পানি ভারসাম্য বুঝতে পারবেন। তবে যদি এতে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখে থাকেন, তবে অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন।* ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মূত্রথলিতে ইনফেকশনঃযখন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মূত্রথলিতে ইনফেকশন সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মেয়েদের সৃষ্টি হয়। তখন মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। দেখা যাবে দিন ও রাতে সবসময়ই ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। দেখা যাবে দিন ও রাতে সমসময়ই ঘন ঘন প্রস্রাব হচ্ছে। সেই সাথে প্রস্রাব করাকালীন জ্বালাপোড়ার জন্য কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সাথে রক্তও আসতে পারে। অন্যদিকে পুরুষদের বেলায় তাদের প্রস্টেটগ্রন্থির প্রদাহ হলে অথবা মূত্রথলি প্রস্টেটগ্রন্থির প্রদাহ থাকে, তাহলে তলপেটে, কুঁচকিতে, মলদ্বারের আশপাশে, মলদ্বারে অ-কোষ ও পুরুষাঙ্গে হালকা মাত্রার ব্যথা আরো ব্যথার ন্যয় অনুভূতি দেখা দিতে পারে। এ সমস্যা প্রস্রাব করাকালীন অথবা বীর্যস্খলনের সময় ছাড়া অন্য সময়েও দেখা দিতে পারে।
* মানসিক সমস্যাঃ-মানসিক সমস্যার কারণে মূত্রথলির প্রদাহ মধ্যবয়স্ক ও বার্ধক্যে দেখা যায়। অনেক মহিলাই অভিযোগ করে থাকেন যে, তার তলপেটে অথবা যৌনাঙ্গে হালকা ব্যথা হচ্ছে, দিনের বেলায় ঘন ঘন প্রস্রাব হলেও রাত্রে প্রস্রাব আবার ঘন ঘন হচ্ছে না। প্রস্রাব পরীক্ষায় কোনো ইনফেকশন পাওয়া যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন যাবত থেকে থাকতে পারে; কিন্তু কোনো কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ সমস্যাগুলোকে তাই মানসিক কারণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।প্রস্রাবকালীন জ্বালাপোড়া যাদের প্রস্রাবকালীন জ্বালাপোড়া বা কষ্ট থাকে, তাদের চিকিৎসার পূর্বে ভালো করে পরীক্ষা করা উচিত; বিশেষ করে বর্তমান ছাড়াও পূর্বে কোনো প্রস্রাবের অসুবিধা ছিল কিনা। মহিলাদের বস্তি দেশের পরীক্ষা এবং পুরুষদের বেলা প্রস্টেট পরীক্ষা অতীব জরুরি, তাছাড়া শারীরিক পরীক্ষা তো অবশ্যই করতে হবে। প্রস্রাব পরীক্ষা, প্রস্টেটগ্রন্থির নিঃসরণ পরীক্ষা এ ধরনের রোগীদের অবশ্যই করা উচিত। আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে, সেটা নির্ভর করবে রোগীর আনুষঙ্গিক উপসর্গের ওপর; যেমন রোগীর এ সমস্যা বারে বারে হয় কিনা, সাথে জ্বর থাকে কিনা ইত্যাদি। এগুলো প্রস্টেটগ্রন্থির তাৎক্ষণিক প্রদাহ হলে বেশি দেখা দেবে প্রস্রাবে ইনফেকশনের তুলনায় বার্ধক্য বয়সে রক্তে সিরাম এসিড ফসফেটেজ বেড়ে গেলে প্রস্টেটগ্রন্থির ক্যান্সার বেড়ে যেতে পারে। শারীরিক পরীক্ষার সময় বস্তি দেশে কিংবা মলনালিতে টিউমার আছে কিনা বা ব্যথা, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায় কিনা ইত্যাদিও দেখা দরকার। যদি শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্ত ও কারণ নির্ণয় কিংবা রোগ শনাক্ত করা না যায়, তাহলে প্রস্রাব ও প্রস্টেটগ্রন্থির নিঃসরণ কালচার করে বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে মূত্রথলির, মূত্রনালির ইত্যাদির অবস্থাও স্বচক্ষে দেখে রোগের কারণ নির্ণয় করা যেতে পারে।*প্রস্রাব ধারণের অক্ষমতাঃ-
প্রস্রাব ধারণের অক্ষমতা এটা হতে পারে দেহের মূত্রনালি, মূত্রথলির ইত্যাদি অস্বাভাবিকতার কারণে কিংবা শারীরিক চাপ, ইনফেকশন, স্নায়ুযন্ত্রের রোগের কারণে অথবা মূত্রথলির সম্প্রসারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, মূত্রথলি বেশি বিস্তৃত হওয়ার ফলে প্রস্রাব ঝরতে পারে। তাছাড়া মহিলাদের জরায়ু নিচে নেমে যাওয়া, কিংবা পুরুষদের প্রস্টেটগ্রন্থি অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে গেলে, দেহের বস্তি দেশ বা পেলিভিসে টিউমার কিংবা ইনফেকশন হলেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ যা-ই হোক, সাধারণত অনৈচ্ছিকভাবে প্রতিবার ১৬০ মিলিমিটারের বেশি প্রস্রাব হয়ে থাকে। টেবলেট ইমিপ্রামিন ২৫ মি. গ্রাম প্রতিবার ১টি করে খেলে অথবা নিফিডিপিন খেলে মূত্রথলির মাংসপেশির সংকোচন ক্ষমতা কমিয়ে আনা যাবে, ফলে প্রস্রাব করার সমস্যার উন্নতি ঘটতে পারে। মূত্রনালির ইনফেকশন, টিউমার অথবা মল জমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যার আলাদাভাবে চিকিৎসা করাতে হবে।
প্রতিরোধ-
কিছু নিয়ম মেনে চললে ইউরিনারি ইনফেকশন প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রস্রাব আটকে না রাখা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, যৌনমিলনের আগে-পরে মূত্রত্যাগ, ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার মাধ্যমে এ সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া ইউরিনারি ইনফেকশনের ফলে সৃষ্ট ব্যথা উপশমে কুসুম গরম পানিতে গোসল অনেকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ঢিলেঢালা পোশাক পরা, সুতি কাপড়ের অন্তর্বাস ব্যবহার, নিয়মিত গোসল, সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিষ্কার রাখা ইত্যাদি খুবই জরুরি।সবশেষে বলা যায়, ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবে সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা নয়।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রস্রাবের সমস্যা খুবই কষ্টকর ও যত্রণাদায়ক দৈনন্দিন সমস্যার মধ্যে একটি। যার হয় বা যেই মানুষের হয় প্রস্রাবের সমস্যা সে জানে কত মানুষিক ও শারীরিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত দিন অতিবাহিত করতে হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই, সত্যহিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ ও যত্র -তত্র অপরিষ্কার স্থানে প্রস্রাব না করিলে এই অসুখ থেকে রেহাইপাওয়াটাও কিন্তু সম্ভব। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানিও জল পান করিলেও অনেক সময় প্রস্রাবের অসুখ ও ইনফেকশন থেকে রেহাই পাওয়া যায়। গরমের দিনে আলকাসল জাতীয় বা গ্লুকোজ জাতীয় পানিও প্রসাবের সমস্যা থেকে রেহাই দিতে পারে। আরেকটি বড় কথা যে আপনাদের সামনে একটুও বলতে চাই সেটা হল, নিজেকে পরিস্কার ও পরিছন্ন রাখতে হবে অর্থাৎ নিজে তো পরিস্কার খাবেন ঠিকই কিন্তু তার সাথে প্রসবের জায়গাটাও কিন্তু আপনাকে পরিস্কার রাখতে হবে যাতে কোনো ভাবে ইনফেকশন আপনাদের জড়িয়ে না ধরে। শেষ কালে সমস্যা বেড়ে গালে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পৰামৰ্শ নিতে ভুলবেন না যেন। ভালো থাকবেন আর সুস্থ থাকবেন।হোমিও সমাধান : হোমিওপ্যাথি হলো একটি লক্ষণভিত্তিক প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। ডা. স্যামুয়েল হানেমান এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তক। তিনি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি সফলতার সঙ্গে এই চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন।হোমিওপ্যাথি লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি বেশি কার্যকর।তাই প্রসাবের সমস্যা সহ যেই কোন জটিল রোগের সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে অভিজ্ঞ ও রেজিস্টার্ড হোমিও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য;
কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি;
স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদ।