শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই শিক্ষাটি কোন ধরনের হওয়া প্রয়োজন। যে শিক্ষা গ্রহণ করে একজন যুবক সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজের জন্য কিছু করতে পারে না সেই শিক্ষা তার জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা হল তাই যা একজন মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য দক্ষ করে তোলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে আমাদের বর্তমান মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা যুবকদের মাঝে সেই দক্ষতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ। সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। নতুন শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে চলছে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ। একটি গুণগত এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রমে।
এটি আমাদের কাছে একটি আশা জাগানিয়া খবর। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞরা বার বার বলে আসছে। শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়নে যে আভাস পাওয়া গেছে তা থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার।
১. পাঠ্য পুস্তকে বড় ধরণের পরিবর্তনের ইঙ্গিত, ২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ৩. দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দান, ৪. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ৫. মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়া, ৬. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার করা, ৭. জীবন ও কর্মমূখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া, ৮. নৈতিক শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেয়া, ৯. প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সংষ্কার করা এবং ১০. মানসম্মত কারিকুলাম নিশ্চিত করা
শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধরণের পরিবর্তন গুলি আনার জন্য দ্রুত গতিতে কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রালয়। তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হলে কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে বাজেট শিক্ষা খাতে দেয়া হয় তা মোট বাজেটের ১৫ শতাংশের নিচে। ইউনেসকো বারবার শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ দেয়ার কথা বলে আসছে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে গুণগত শিক্ষার জিকির তুলে কোন লাভ হবে না। ব্যানবেইস এর তথ্য মতে মাধ্যমিক স্তরে ৩০ শতাংশ শিক্ষকের কোন প্রশিক্ষণ নেই। ৩০ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞানাগার নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে কাটিয়ে না উঠতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গাইড ও নোট বইয়ের উপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা কমাতে হবে। মানসম্মত পাঠ্য বই তৈরি ও শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অতিরিক্ত কোচিং প্রবনতা কমাতে হবে। গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের সুপ্ত মেধাকে বিকশিত হতে বাধা দেয়। তাই এ দুটির লাগাম টেনে না ধরতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
৪. পাঠ্য বইতে প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে দিতে হবে। নির্ধারিত প্রশ্ন ব্যাংক থেকে সৃষ্টিশীল প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে হবে।
৫. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতি গুণগত শিক্ষার জন্য মোটেও অনুকুল নয়। অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ, পরীক্ষায় জিপিএ ৫ লাভের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা গুণগত শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়েছে দাঁড়িয়েছে।
৬. মুখস্থ নির্ভর ও সনদ নির্ভর শিক্ষার জালে আমরা এখনো আটকা পড়ে আছি। শিক্ষা জীবন শেষে শুধু একটি কাগজই হাতে আসে মাত্র। কোন ধরনের দক্ষতা তৈরি হয় না। যার ফলে বেকারদের লম্বা সারি তৈরি হচ্ছে।
৭. দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য। কেননা একটি জরিপে দেখাচ্ছে যে শতকরা ৯০ শতাংশ শিক্ষর্থী প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে অংকে দুর্বলতা নিয়ে। তাই যোগ্য শিক্ষক দরকার হবে। এজন্য শিক্ষকদের ভাল বেতন ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. জীবন ও কর্মমূখী শিক্ষা ছাড়া আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। এজন্য কারিগরি, ভোকেশনাল, ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
৯. শিক্ষকদের উচ্চ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০. উচ্চ শিক্ষার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন নেই। উচ্চ শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ গবেষণাধর্মী।
শিক্ষা নীতিমালা ২০১০-এ যে নির্দেশনাগুলো আছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে আর কোন বাধা থাকবে না। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি মানসম্পন্ন হয় তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন দ্রুত হয়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপাল গুণগত শিক্ষার দিকে হাটছে। দক্ষ যুব সমাজ তৈরি করতে পারলে আমরা সহজেই উন্নত দেশের কাতারে যুক্ত হতে পারবো।
শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। বার বার সিলেবাস পরিবর্তন, পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করলে শিক্ষার্থী সেটার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তাই একটি স্থায়ী ও মানসম্মত শিক্ষাক্রম, যুগপোযোগী সিলেবাস ও পাঠ্য পুস্তক এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকদের ভাল বেতন না দিতে পারলে গুণগত শিক্ষার প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক ভাল দিক আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে বড় বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি না করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। শিক্ষাখাতে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অরাজকতা দূর করতে হবে। শিক্ষাবিদদেরকে শিক্ষাখাতের চালিকা শক্তি হিসাবে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা আর যাই হোক গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এক ধরনের নয়। শিক্ষায় সমতা আনতে হলে সমগ্র শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে। শহর ও গ্রামের শিক্ষার মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য অবশ্যই কমাতে হবে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা একটি দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নতুন কিছু নয়। আর শিক্ষকদেরকে বেতনের এমন বৈষম্যের মধ্যে রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সংস্কারগুলি শুধু কাগজে বন্দি থাকলে কোন লাভ হবে না। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য দরকার হবে শিক্ষকদের। আর সেই শিক্ষকদেরকে বঞ্চিত রেখে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
করোনা মহামারির কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে বড় ধরনের ক্ষতি ঘটে গেছে। শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন হবে। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে করোনার এই মহামারির সময়ে ঝরে পড়েছে। তাদেরকে পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমকে সাজাতে হবে। করোনার এই মহামারির সময়ে অনেক নারী শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহের শিকার হয়েছে।
শিক্ষায় বৈষম্য কমানোর জন্য একীভূত শিক্ষার উপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন, পদন্নোতি সহ নানা ধরনের বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য গুলির নিরসন প্রয়োজন। আর এটার নিরসনে শিক্ষাবিদরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণের কথা বলেছেন। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে নানা ধরনের জটিলতা ছিল। এন টি আর সি এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে জটিলতার মুখোমুখি হয়। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের এই অচলায়তন দূর করার জন্য নানামুখি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তেমন অগ্রগতি এখনো দৃশ্যমান নয়। দেশে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। এমন অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানে প্রতি ক্লাশে শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে একটি ক্লাসে বসিয়ে কোন শিক্ষকের পক্ষেই গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের কথা বলে থাকেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ভারসাম্যপূর্ণ না হলে গুণগত শিক্ষার ধারণাটি কল্পনা মাত্র।
শিক্ষাকে কেউ কেউ ব্যবসা হিসাবে নিয়ে থাকেন। আর এ ধরনের মানসিকতা গুণগত শিক্ষার বড় অন্তরায়। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য থাকে পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের শতভাগ পাশ নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে এটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শুধু শত ভাগ পাশের পিছনে দৌড়ালে চলবে না। শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় পাশ করা আর মানসম্মত শিক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। পরীক্ষায় পাশ করে একজন শিক্ষার্থী হয়তো একটি সনদ লাভ করে কিন্তু সে নিজে দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে না। সনদ নির্ভর শিক্ষা হওয়ার কারণে আজ দেশে এত বেকার সমস্যা। সবাই শুধু সনদের জন্য মরিয়া। প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে তারা নিজেদেরকে তৈরি করতে পারে না।
নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ কমবে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পরীক্ষা ভীতি থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে আসতে পারবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা খুবই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও যৌক্তিক। পূর্বে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বানিজের বিভাজন ছিল। সেটা তুলে দেয়া হবে নতুন শিক্ষাক্রমে। এটাও একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই একই ধরনের শিক্ষা পাবে যার ফলে তাদের একটি সৃজনশীল ব্যাসিক তৈরি হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে কোচিং ও গাইড ব্যবসাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষাখাতে অপরাজনীতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সমন্বিত উদ্যোগই পারে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে। শিক্ষার নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি সরকারকে শিক্ষা জাতীয়করণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে সর্বপ্রথম মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষার প্রতি।
লেখক : কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট;
সহকারী অধ্যাপক, বি এ এফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলা, ঢাকা সেনানিবাস।