ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২ নভেম্বর ২০২৩
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও অন্যান্য
  5. খেলাধুলা
  6. গল্প ও কবিতা
  7. জাতীয়
  8. তথ্যপ্রযুক্তি
  9. দেশজুড়ে
  10. ধর্ম ও জীবন
  11. প্রবাস
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. বিশেষ প্রতিবেদন
  15. মুক্তমত
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ, বনপ্রহরী বদলি

মশিউর রহমান
নভেম্বর ২, ২০২৩ ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

দেশে যত সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি তার মধ্যে অন্যতম। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও দুর্নীতি থেমে নেই। সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারির কারণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। উন্নয়ন প্রশংসিত হলেও দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে সুশাসন আজ প্রশ্নবিদ্ধ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমগ্র দেশে বন অধিদপ্তর এক বিশাল ভূমিকা পালন করলেও কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে উন্নয়নের গতি কখনও কখনও থমকে যায়। দৈনিক পাঞ্জেরী’র আজকের প্রতিবেদন ঢাকা বন বিভাগের আওতাধীন রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারির ঘুষ-বাণিজ্য নিয়ে। তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাদের ঘুষ-বাণিজ্যের নানা কৌশল। জানা গেছে, রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিটে দখল বাণিজ্য রক্ষায় চলছে দুর্নীতিবাজদের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ।
রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানার বিরুদ্ধে মূল্যবান বনভূমি ব্যক্তি মালিকানায় বুঝিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, রাজেন্দ্রপুর পূর্ব বিট এলাকার ইজ্জতপুর কবরস্থানের পাশে প্রায় ৫ গন্ডা বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ পাকা ৩ রুমের বাড়ি নির্মাণ করেছেন ফল ব্যবসায়ী কদম আলী। নতুন এই বাড়ি করার সময় বিট অফিস ২ দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে একাধিকবার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও রেঞ্জ কর্মকর্তা তদন্তের নামে তালবাহানা করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ডিমারকেশনের কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আরএস রেকর্ডমূলে জমি দখলদারকে বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্দেশে তিনি সম্প্রতি সার্ভেয়ার নিয়ে মাপজোখও করেছেন। অথচ কাফিলাতলী মৌজার সিএস ৫৮নং দাগের ওই জমি সম্পূর্ণ সংরক্ষিত বনভূমি। দাগটি সিএস রেকর্ডে পার্ট না থাকায় ব্যক্তি নামে ডিমারকেশনের কোন সুযোগ নেই। আরএস রেকর্ড নিয়ে বন বিভাগের পক্ষে আদালতে রেকর্ড সংশোধনীর মামলাও চলমান রয়েছে।
সূত্র জানায়, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ রেঞ্জ কর্মকর্তার নামে কদম আলীর কাছ থেকে আরও টাকা নিয়েছেন। তাই স্থাপনা উচ্ছেদ ও বনের ক্ষতিসাধনের মামলা করা হচ্ছে না।
ইজ্জতপুর রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে কাফিলাতলীতে প্রায় ৫ গন্ডা জমি দখল করে রঙিন টিন ও লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে ৩ রুমের বাড়ি নির্মাণ করেন সিরাজুল ইসলাম। তুলে ফেলা হয় সুফল প্রকল্পের চারা। বিট অফিস সেখান থেকে ২ দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। গত ১২ সেপ্টেম্বর রেঞ্জ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সিরাজুলের বাড়ির কিছু টিন ও চারপাশের টিনের বেড়া খুলে রাখা হয়। কাটার মেশিন দিয়ে কেটে দেওয়া হয় চালার ২টি লোহার অ্যাঙ্গেল। কয়েক দিন পর বনপ্রহরী ফিরোজ শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার বেড়া দিয়ে বাড়ি মেরামত করা হয়েছে।
ইজ্জতপুর স্কুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ব্লক ইট তৈরির কারখানা স্থাপন করছেন ঢাকার শাহাদাত হোসেন। সেখানে মালবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য বনভূমি দখল করে ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে রাস্তা নির্মাণ করা হয়। বিট অফিস তার কাছ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে বনের অংশে চারা রোপণ করা হয়েছে। তবে বৃহৎ প্রজেক্টটির ৩ পাশে বনভূমি থাকলেও যৌথ ডিমারকেশনের খুঁটি পাওয়া যায়নি। ইজ্জতপুর বাজারের পূর্ব পাশে আকাশমনি বাগানের শতাধিক চারা বিনষ্ট করে প্রায় ১৫ শতাংশ বনভূমি দখল করেছেন সৌদি প্রবাসী খাইরুল বাশার রিপনের স্ত্রী ইয়াসমিন। বিট অফিসে টাকা দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি।
রেঞ্জ অফিস সংলগ্ন পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে বনভূমি দখল করে একটি টিনশেড দোকান করেন ডিশ ব্যবসায়ী আরিফ। পরে সেটি উচ্ছেদ করে চারা রোপণ করা হয়েছে।
ধলাদিয়া এলাকায় ঢাকা-কাপাসিয়া রোডের দক্ষিণ পাশে আকাশমনি বাগানের অংশ দখল করে নতুন একটি পাকা দোকান নির্মাণ করেন মহব্বত আলী ওরফে হঠাৎ মুন্সি। অভিযোগ উঠলে একবার অর্ধেক অংশ ভেঙে দেওয়া হয়।
পরে বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে বাকি অংশ না ভাঙা ও মামলা না দেওয়ার কথা বলে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাকি অংশ অদ্যাবধি ভাঙা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেঞ্জ কর্মকর্তা বন দখলকারী সিরাজুল ইসলাম ও শাহাদাত হোসেনকে অফিসে ডেকে নিয়ে টাকা লেনদেনের স্বীকারোক্তি নেন। পরে বিট কর্মকর্তা ফরেস্টার একেএম ফেরদৌস ও ক্যাশিয়ার খ্যাত বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ তাকে ম্যানেজ করে বাণিজ্য ধামাচাপা দেন।
এদিকে ধলাদিয়া এলাকার ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন ওরফে আলা তার ছেলের জন্য জোত জমিতে বাড়ি নির্মাণ করছেন। গত ৩ অক্টোবর বিকেলে বিট কর্মকর্তা ও ফিরোজ শেখ গিয়ে ডিমারকেশন ছাড়া কাজ করার অভিযোগ তুলে একজন শ্রমিককে ধরে নিয়ে যান অফিসে। পরে রাতে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ইজ্জতপুর রোড থেকে পিকআপ বোঝাই আকাশমনি গাছসহ দু’জনকে আটক করেন বিট কর্মকর্তা ও ফিরোজ শেখ। গাছগুলো নলজানি এলাকার ব্যবসায়ী এনায়েতের। পরে রাতে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছাড়া হয়।
এ ঘটনায় পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার দেখিয়ে একটি ইউডিআর মামলা দেওয়া হয়েছে। এখন গাড়ি ছাড়া বাবদ আরও টাকা দাবি করে। গত ২ অক্টোবর বিকেলে আতলড়া এলাকা থেকে ব্যবসায়ী জামানের পিকআপ বোঝাই আকাশমনি গাছসহ একজনকে আটক করা হয়। রাতে টাকা নিয়ে আটককৃত ব্যক্তিকে ছাড়া হয়। পরে গাড়ি ছাড়ার চুক্তি করে পিকআপের বদলে পরিত্যক্ত টমটম দেখিয়ে ইউডিআর মামলা দেওয়া হয়েছে।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস ও বনপ্রহরী ফিরোজ শেখ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ফিরোজ শেখ বলে বেড়াচ্ছেন, এসিএফ আমার পকেটের লোক। আমি তার বাসায় দামি ফার্নিচার দিয়েছি। এসব লেখালেখিতে কিছুই হবে না।
অপরদিকে ফাওগান রোডের পূর্ব পাশে নিশ্চিন্তপুর টেকপাড়া পোলট্রি রাস্তা। ঘন গজারি বনের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটার এই পথ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের কার্যক্রম চালাচ্ছে ‘গ্রে ডি স্টুডিও’ নামের একটি নির্মাণাধীন রিসোর্ট। রিসোর্টের ঢাকাস্থ মালিক পক্ষ স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে রাস্তাটি ইটের সলিং করার চুক্তি করে। পরে তারা গত মাসে বিট অফিসে তিন লাখ টাকা দিয়ে বালু ফেলে ইট বসানোর কাজ শুরু করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক পর্যায়ে ঘটনাটি জানাজানি হলে রাস্তা বন্ধের নামে ৭০০-৮০০ ফুট দৈর্ঘ্য অংশে আকাশমনি চারা রোপণ করা হয়। তবে গাড়ি চলাচলের জন্য মাঝখানে ৮-১০ ফুট করে ফাঁকা রাখেন বিট কর্মকর্তা ও ফিরোজ শেখ।
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর গত ২০ সেপ্টেম্বর সকালে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম সাজজাদ হোসেনের নির্দেশে ফাঁকা অংশসমূহে চারা রোপণ করা হয়।
এর কয়েক দিন পর দুষ্কৃতিকারীরা স্থানীয় লোকদের উসকানি দিয়ে চারাগুলো তুলে ফেলে। পরে রাস্তার কিছু কিছু অংশ কেটে দিয়ে আবার কিছু চারা রোপণ করে বিট অফিস। কিন্তু মূল অপরাধীরা এখনো আইনের আওতায় আসেনি।
এলাকাবাসী বলছেন, রাস্তাটি দিয়ে বনের স্বার্থে রিসোর্টের গাড়ি চলাচল বন্ধে তাদের আপত্তি নেই। যেহেতু এই রাস্তা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিপুলসংখ্যক মানুষ চলাচল করেন, সেহেতু মানবিক কারণে হাঁটাচলার জন্য কিছু জায়গা ফাঁকা রাখলে কারও উসকানি কাজে আসবে না।
আতলড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফার বাড়ির কাছে সুফল প্রকল্পের পাশে কয়েক বছর আগে আকাশমনি বাগান সৃজন করে বিট অফিস। বাগানটিতে প্রায় আড়াই হাজার চারা রোপণ করা হয়।
গত আগস্টে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তিন শতাধিক চারা কেটে প্রায় দেড় বিঘা বনভূমি দখল করেন। অভিযোগ উঠলে বিট অফিস আবার চারা রোপণ করে। এ ঘটনায় বনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হলেও রহস্যজনক কারণে মামলা করা হয়নি।
অনিয়মের বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষকের নজরে আসলে গত ৩০ অক্টোবর এক আদেশে বনপ্রহরী ফিরোজ শেখকে বরিশাল কোস্টাল সার্কেলে বদলি করা হয়।
কিন্তু ফরেস্ট রেঞ্জার জুয়েল রানার দোসর হিসেবে বিট কর্মকর্তা ফেরদৌস নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এখন আরও বেপরোয়া।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানাকে বেশ কয়েকবার দৈনিক পাঞ্জেরী’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এছাড়া অভিযুক্ত বিট কর্মকর্তা এ কে এম ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সার্কেলের বন সংরক্ষক হোসাইন মুহম্মদ নিশাদ বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’