দুর্নীতির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলাধীন কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের ৪ জন নকলনবিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত টি.সি মোহরার আব্দুস সাত্তারকে একজন বহিরাগত ব্যক্তি বিবেচনায় দাপ্তরিক কাজ-কর্মে হস্তক্ষেপ বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ অফিস আঙিনায় প্রবেশ নিষিদ্ধকরণের জন্য ঢাকা জেলার জেলা রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৪ জন নকলনবিশ হলেন- পারুল আক্তার, বজলুর রহমান, আব্দুর রহিম এবং আরিফুল ইসলাম। গত ১৯ ডিসেম্বর নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক উম্মে কুলসুম স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। নকলনবিশ পারুল আক্তার ও তার স্বামী (অবসরপ্রাপ্ত) টি.সি মোহরার আব্দুস সাত্তার এবং তাদের সহযোগী নকলনবিশ বজলুর রহমান, আব্দুর রহিম এবং আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের একচ্ছত্র আধিপত্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
ঢাকা জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা ধামরাই। ১৬ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ধামরাই উপজেলা। ধামরাই উপজেলার কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে বছরে ১৫-১৬ হাজার দলিল সম্পাদিত হয়। এতো বড় অফিসে যে কোন সাব রেজিস্ট্রার ঘুষ বাণিজ্যর জন্য টাকা খরচ করে বদলি হয়ে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। সরকারিভাবে একটি সাব রেজিস্ট্রি অফিসে একজন সাব রেজিস্ট্রার, একজন সহকারী, দুইজন মোহরার, একজন পিয়ন ও প্রয়োজন অনুয়ায়ী (এক্সট্রা মোহরার) নকলনবিশ থাকার কথা। দলিল যাচাই-বাছাই করার কথা রয়েছে সাব রেজিস্ট্রার অথবা তার সহকারীর। কিন্ত কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি নিয়ম-নীতির কোনো বালাই নেই। এখানে সব ক্ষমতা অফিসের একজন নকলনবিশ পারুল আক্তারের হাতে। অফিসে দলিল নিয়ে প্রবেশ করেই সবার আগে তিনি দলিল চেক করার নামে কোন দলিলে কত টাকা ঘুষ দিতে হবে তা নিয়ে কথা বলতে হবে। ঘুষের টাকার পরিমাণ ঠিক হলে পারুল আক্তার দলিলে একটি সংকেত চিহ্ন লিখে দিলে তারপর সাব রেজিস্ট্রার সেই দলিল সম্পাদন করবেন। সাব রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে নকলনবিশ পারুল আক্তার কালামপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রাজস্ব লুট করতে গড়ে তুলেছেন একটি অসাধু সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা নকল নবিশ পারুল ও তাদের অনুসারী কিছু দলিল লেখকরাও। তারা নাল জমিকে ডোবা ও নালা দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সাব-রেজিস্ট্রার ও নকলিনবশ পারুলসহ অসাধু কতিপয় দলিল লেখকগণ। সাধারণ দলিল লেখকরা তার কাছে অসহায়। সাব রেজিস্ট্রারের নির্দেশে চলছে প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য যেখানে এর প্রতিবাদ করার কোন ব্যক্তিই নেই।
অফিসে আধিপত্য বিস্তার ও স্বামী-স্ত্রীর (সাত্তার-পারুল) সিন্ডিকেট টিকিয়ে রাখতে বহিরাগতদের দিয়ে পাহারায় রাখা হয় কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি কার্যালয়। ইতিপূর্বে পাহারা দেয়ার চিত্র ধারণ করায় সাংবাদিকরা হেনস্থার শিকার হন। শুধু তাই নয় সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও এনড্রয়েড মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ভিডিও চিত্র ডিলেট করেও ফেলে ওই সিন্ডিকেটের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা। পারুল আক্তারের স্বামী এহেন কাজ নেই যা তিনি করেননি। নিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে ৪ জন বরখাস্ত হওয়ার পর সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পারুল আক্তার অফিসের কাগজপত্র এখনও বুঝিয়ে দেননি। অন্যদিকে তার স্বামী আব্দুস সাত্তার অফিসের কেরানী আব্দুর রহমানসহ সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল মতিনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেট কালামপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় তাদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থের জোরে অসাধু লোকজনকে ভাড়া করে পেশীশক্তি প্রদর্শন করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাদের ইন্ধনে কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সরকারি কর্মচারিদের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে বিধায় তারা শঙ্কিত। এছাড়াও সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেট অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল কিংবা ফাইলপত্র গায়েব করে দিতে পারে বলে সূত্র জানায়। তাদের ইন্ধনে উক্ত ভবনের ক্ষতির আশংকা করছেন অনেকেই। সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেট দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি ভবন। অত্যন্ত সুচতুর নকলনবিশ পারুল আক্তার তার নানা কৌশল দিয়ে সাব রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে নিতেন। কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের অন্যান্য নকলনবিশগণ পারুল আক্তারের কাছে ছিল অবহেলিত এবং অসহায়। দুর্নীতিবাজ নকলনবিশ পারুল আক্তারসহ ৪ জন বরখাস্ত হওয়ায় কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত অন্যান্য নকলনবিশদের মাঝে স্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। তারা অনেকে মিষ্টি বিতরণও করেন। মুজিবনগর কোটায় নিয়োগকৃত সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল মতিনও সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেটের কাছে ছিল অসহায়। কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন দলিল থেকে অনৈতিক উপায়ে যে আয় বাণিজ্য হতো তার অধিকাংশই সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেট পকেটস্থ করতো বলে সাব রেজিস্ট্রার আব্দুর মতিন তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দুঃখ করে বলতেন। এই দানবীয় সিন্ডিকেট সাত্তার-পারুল গংদের কাছে জিম্মি ছিল সবাই। সুতরাং সরকারি কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে সাত্তার-পারুল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কালামপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত ভুক্তভোগী কর্মচারি ও শান্তিপ্রিয় নকলনবিশ এবং দলিল লেখকগণ।