জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের কথা বলেছেন দলটির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। তবে দলের সংসদ সদস্যরা তীব্র সমালোচনা করেছেন এরশাদের এই বক্তব্যের। জাপার সাংসদরা মনে করেন, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত মানা হবে। যেহেতু এরশাদ সংসদীয় দলের ক্ষেত্রে প্রধান নন, সেখানে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন না।
অন্যদিকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জাপার সংসদ সদস্যরা।
সোমবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত জাপার সংসদীয় দলের সভায় এ নিয়ে এরশাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত এক সংসদ সদস্য বলেন, মন্ত্রী থেকে পদত্যাগের কথাটি একান্তই এরশাদের নিজস্ব। দলের প্রেসিডিয়াম কিংবা সংসদীয় দলের সঙ্গে এই বক্তব্যের কোনো সম্পর্ক নেই। বিকেল ৪টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা এই বৈঠক চলে।
সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে একাধিক সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘যদি সরকার থেকে বের হতে হয়, তাহলে আগে এরশাদকে পদ ছাড়তে হবে। তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত থেকে আমাদের এই কথা বলতে পারেন না। দলীয় চেয়ারম্যান হলেও এরশাদের একক সিদ্ধান্তে সংসদীয় দল চলবে না।
বিরোধী দলীয় নেতা ও জাপার সংসদীয় দলের প্রধান বেগম রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় অবশ্য এরশাদ উপস্থিত ছিলেন না। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুও বৈঠকে ছিলেন না। তবে সকলের সম্মতিক্রমে সভায় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধী দলীয় উপনেতা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মনোনয়নের সভায় উপস্থিত থাকা প্রায় ৩০ জনের মতো সংসদ সদস্য লিখিত রেজুলেশন নিয়েছেন। বৈঠকে সংসদ সদস্য- কাজী ফিরোজ রশীদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, সেলিম উদ্দিন, নূরুল ইসলাম মিলন, সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তা, শওকত চৌধুরী, এমএ হান্নান, নূর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, সালমা ইসলাম, মেরিনা রহমান, অধ্যাপিকা রওশন আরা মান্নান ও পীর ফজলুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বলেছেন, সরকার গঠন হওয়ার আগে সংসদীয় দলের সভায় সর্বসম্মতভাবে মন্ত্রিসভায় যোগদানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হলেও সংসদীয় দলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই দলের চেয়ারম্যানের বলা উচিত নয়, জাপা শিগগিরই মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসবে। চেয়ারম্যান তো পাঁচ জানুয়ারির
নির্বাচনও না করার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজে এমপি, মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। নিজে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে অন্যদের পদত্যাগের কথা বলা তার মুখে মানায় না।
বৈঠকে থাকা একাধিক সংসদ সদস্য জানান, এসব বক্তব্যের সময় রওশন একেবারেই চুপচাপ ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সংসদ সদস্য বলেন, এরশাদ দলের নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে বের হয়ে আসতে বলায় বৈঠকে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। এরশাদের তীব্র সমালোচনা করে রাঙ্গা বৈঠকে বলেছেন, ‘উনি (এরশাদ) একেকবার একেক কথা বলে শুধু জনগণকেই বিভ্রান্ত করছেন না, দলের নেতা-কর্মীদেরও বিভ্রান্ত করছেন। তিনি দলের চেয়ারম্যান হতে পারেন, তবে সংসদীয় দলের প্রধান নন। তাই সংসদীয় দলের ওপর তিনি কোনো সিদ্ধান্ত
চাপিয়ে দিতে পারেন না। এখন থেকে আমরা এমপিরা তার কোনো একক সিদ্ধান্ত মানব না।
এসময় রওশন এরশাদকে উদ্দেশ্য করে রাঙ্গা বলেছেন, ‘আপনার নেতৃত্বে সংসদীয় দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটিই মানবো। এরশাদের ভূমিকা নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্যদের প্রতিবাদের জবাবে রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘আপনারা জানেন কী পরিস্থিতিতে আমরা পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। উপরে আল্লাহ, নিচে আপনারা তা জানেন। নির্বাচনে যেন না যাই, সেজন্য এরশাদ সাহেব আমাকে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে বলেছিলেন- নির্বাচন থেকে
না সরলে তোমার বাড়িতেও সন্ত্রাসীরা বোমা মারবে। সেসব তো আমি ভুলিনি। আমরা সরকারে থাকব কী থাকব না, সে বিষয়ে প্রয়োজনে সংসদীয় দলের পরবর্তী সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। এখন আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, দলকে সংগঠিত করার জন্য সবাই কাজ করুন।’
এ বিষয়ে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ফিরোজ রশীদকে উপনেতা মনোনয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিরোধী দলের লিখিত রেজুলেশনসহ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয়া হবে।
মন্ত্রিত্ব ত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উনি (এরশাদ) নিজেও মন্ত্রী পদমর্যাদায় আছেন। কাজেই অন্যদের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বলার আগে তার পদত্যাগ করা উচিত। বৈঠকে সবাই মত দিয়েছেন কারও একক সিদ্ধান্তে নয়, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদীয় দলের সিন্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
তবে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, পদত্যাগের বিষয়ে দলের প্রেসিডিয়াম কিংবা সংসদীয় দল-কোনটিরই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।