কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামী হত্যায় সদ্য অবসরে পাঠানো (কেএমপি) কমিশনার মোজাম্মেল হক, এডিশনাল কমিশনার সরদার রাকিকুল ইসলাম, এডিশনাল কমিশনার তাসলিমা খাতুন সরাসরি জড়িত বলে জানা যায়। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, গত ২ আগস্ট শুক্রবার খুলনা গল্লামারী, জিরো পয়েন্টে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিলে তারা মাত্র ১০-১২ জন পুলিশকে রুখে দিতে বলেছিল। যেটা তারা জানতো যে কখনোই এই ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য দিয়ে হাজার হাজার বিক্ষুপ্ত ছাত্র জনতাকে রুখে দেয়া সম্ভব না। জেনেও তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং মেরে হোক, গুলি করে হোক, যেভাবেই হোক তারা ছাত্র জনতার মিছিলকে রুখে দিতে বলেছিল। খুলনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যা কিছু ঘটেছে তা এই ৩ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদেই ঘটেছে বলে জানা যায়। সেদিন নিশ্চিত পুলিশকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল সদ্য অবসরে পাঠানো (কেএমপি) কমিশনার মোজাম্মেল হক, এডিশনাল কমিশনার সরদার রাকিবুল ইসলাম এবং এডিশনাল কমিশনার তাসলিমা খাতুন।
উলেখ্য, গত ২ আগস্ট শুক্রবার খুলনা গল্লামারী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামী নিহত হয়। রাতে স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনা সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান তার স্ত্রী মিতু বিশ্বাস। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তা, আত্মীয় স্বজন যাকেই পেয়েছেন তাকে জড়িয়ে ধরে এমন কি পায়ে ধরে স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান। হাসপাতলে বাবাকে বারবার খুঁজেছে তার ৬ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে স্নিগ্ধা। কি এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। সেদিন তার স্ত্রী মিতু বিশ্বাস কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন ‘আমার সব শেষ হয়ে গেলো, আমার বেঁচে থাকার আর কোন ঠিকানা রইলো না। এই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে কীভাবে আমি বাঁচবো। কী হবে আমাদের ভবিষ্যতের। কিছুই জানি না।
সদ্য অবসরে পাঠানো খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ( কে এম পি) কমিশনার মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে বদলী বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। জানা যায়, মেট্রো এলাকায় ওসি বদলী বাবদ তাকে দিতে হতো ৫ লাখ টাকা, এসআইদের থানা থেকে অন্য থানায় বদলীর জন্য ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা দিতে হতো তাকে। এছাড়া সিটিএসবিতে বদলী নিতে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হত পুলিশ কমিশনারকে। এএসআই ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হতো। সূত্র জানায়, এসব টাকা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন কেএমপির পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুর রহমান ( নিরস্ত্র), বিপি নং – ৭৬০২০৫০০৯৬, পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন ( নিরস্ত্র), বিপি নং ৭৯০৬১০২৯৮০, সিটিএসবির এএসআই ( নিরস্ত্র) আব্দুর রাজ্জাক, বিপি নং ৮৯০৯১২০৩৬৭। এসব অবৈধ টাকা তারা কোথায় রাখতো তা জানা যায়নি। তবে গোয়েন্দা তদন্তে বেরিয়ে আসবে সব থলের বিড়াল এমনটাই আশা করেন সচেতন মহল।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, খুলনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের এ্যাকশন। জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ১৫ বছর হয়রানি এবং গ্রেফতারে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে গোপীনাথ কানজিলাল (এসি সদর ) ও খুলনা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক নিমাই চন্দ্র। গোপীনাথ কানজিলাল (এসি সদর ) ও নিমাই চন্দ্রের ( ওসি তদন্ত) সদর থানা মিলে কমিশনার মোজাম্মেল হকের হয়ে কাজ করতেন। গত ৯ আগস্ট সদ্য অবসরে পাঠানো কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল হকের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের এক মতবিনিময় সভায় গোপীনাথ কানজিলালসহ ৮ পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানানো হয়। গত ৩১ জুলাই আন্দোলন চলাকালে নগরীর রয়েল মোড়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন চেক করের এই গোপীনাথ কানজিলাল। সেখান থেকে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেও সাধারণ মানুষকে হয়রানির গুরুতর অভিযোগও রয়েছে গোপীনাথ কানজিলাল ও নিমাই চন্দ্রের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যেদিন সুমন কুমার ঘরামী নিহত হয় (২ আগস্ট ) ঐ দিন বিকালে খুলনা ইউনিভার্সিটি থেকে কয়েক হাজার ছাত্রের একটি মিছিল যাচ্ছিল শিববাড়ি মোড়ের দিকে। সদ্য অবসরে পাঠানো কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল হক ও অতিরিক্ত কমিশনার সরদার রকিব এবং অতিরিক্ত কমিশনার তাসলিমা খাতুনসহ যারা লিডিং পর্যায়ে ছিলেন। তারা ওইখানে থাকা অল্প কিছু সংখ্যক পুলিশকে ছাত্র জনতার মিছিলটিকে বাধা দিতে বলেন এবং মিছিলটি শিববাড়ি মোড়ে যেন না যেতে পারে সে ব্যাপারেও কড়া বার্তা দেন পুলিশ সদস্যদের। ঐ মিছিলটিতে যখন পুলিশ বাধা দেয় তখনই শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ। এর আগে দুপুর সাড়ে ৩ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত খুলনার জিরো পয়েন্ট, হরিণটানা থানা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী ও জনতা গুরুতর আহত হয়েছিলো। তারপর বিকাল সাড়ে ৫ টার দিকে যখন শিক্ষার্থী ও জনতা এক জোট হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে শিববাড়ীর দিকে রওনা হয় ঠিক সেই মুহূর্তে আবার পুলিশ এলোপাতারি গুলি চালায় গল্লামারী মোড়ে। পুনরায় সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ ও বিক্ষুপ্ত ছাত্র জনতা। তখন গল্লামারী ব্রিজের পাশে মাছ বাজারের গেট সংলগ্ন প্রায় ৮ থেকে ১০ জন পুলিশ আটকা পড়ে যায়। একদিকে গল্লামারী মোড়ে শিক্ষার্থী ও পুলিশের চলছে তুমুল লড়াই। পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডে কেঁপে ওঠে পুরো গল্লামারী ও আশপাশের এলাকা। কিন্তু ততক্ষণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুলিশ লাইন্সে কর্মরত সুমন কুমার ঘরামী। ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারান। পুলিশেরও অন্তত ২০-২৫ জন সদস্য আহত হয়েছিল সেদিন সংঘর্ষে। সূত্র জানায়, সোনাডাঙ্গা জোনের এএসপি সার্কেলের বডিগার্ড ছিল কনস্টেবল সুমন। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে তিনি ভয়ে আগে থেকেই পালিয়ে যান।
কনস্টেবল সুমন হত্যায় অবসরে পাঠানো (কেএমপি) কমিশনার মোজাম্মেল হক, এডিশনাল কমিশনার সরদার রাকিবুল ইসলাম ও এডিশনাল কমিশনার তাসলিমা খাতুন জড়িত বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়। সেদিন পুলিশের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করলে হয়তো সুমন মারা যেত না। এ জন্য একমাত্র উপরোক্ত ৩ পুলিশ কর্মকর্তাকেই খুলনার সচেতনমহল দায়ী করছেন।
খুলনা মহানগরীতে অবসরে পাঠানো মোজাম্মেল হকের সকল অন্যায় ও অপরাধের বাস্তবায়নকারী ছিলের খালিশপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন, লবণচরা থানার ওসি হাফিজুর রহমান, সিটি এসবির এস আই রুহুল আমিন, এএসআই হারুনুর রশিদ, এএসআই মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এবং তার অফিস অর্ডারলি কনস্টেবল জসিম, গোপীনাথ কানজিলাল (এসি সদর) ও নিমাই চন্দ্র (ওসি তদন্ত) খুলনা সদর থানা। তবে এএসআই ( নিরস্ত্র ) আব্দুর রাজ্জাকও তাদের বিশ্বস্ত ছিলেন। এ কারণে তার দৌরাত্ম্যও কম ছিল না। পুলিশ কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামী হত্যাসহ খুলনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশী এ্যাকশনে জড়িত কেএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাদের বিচার দাবী করেছেন খুলনার সচেতনমহল। বিশেষ করে সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো (কেএমপি) পুলিশ কমিশনার মোজাম্মেল হকের অপরাধের বিচারের দাবি উঠেছে বেশ জোরেশোরে।