দেশে হঠাৎ করে সামাজিক অপরাধ অনেক বেড়ে গেছে। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি অপরাধ বাড়ছে। এসবের সঙ্গে খুন-জখমের ঘটনাও ঘটছে। মানুষ এতে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কগ্রস্ত। জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশ তাদের দিশাহারা করে তুলছে। অর্ন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলেও এক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা শোচনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ডিএমপি কমিশনারের চলার পথে মোবাইল ও ব্যাগ সাবধানে রাখার পরামর্শ থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। ছিনতাইকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে, পথচারী বা রিকশাযাত্রীদের ছুরিকাঘাত করতেও পিছপা হচ্ছে না। গণমাধ্যমে প্রতিদিনই ছিনতাই, চাঁদবাজির খবর প্রকাশ হচ্ছে। রাজধানীর অনেক এলাকার মানুষই এ জন্য আতঙ্কে আছেন। এর মধ্যে উত্তরায় ছিনতাই আতংক দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি কিশোর গ্যাং, টানাপার্টি, মলমপার্টির দৌরাত্ম্যও বেড়েছে। বলা বাহুল্য, শুধু উত্তরাতে নয়, রাজধানীর সব এলাকাতেই অনুরূপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চুরি-ডাকাতি হাচ্ছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদিও ক্রমশ ভয়ংকর রূপ লাভ করছে। ইতোমধ্যে উত্তাপ বেড়েছে ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ডে’। সন্ত্রাসীদের অনেকেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও প্রভাববলয় বিস্তারে তৎপর। মগবাজার, মালিবাগ, ধানমন্ডী, মিরপুর, মোহম্মাদপুর, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা বেপরোয়া দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তারা জমি, ভবন, মার্কেট দখল করছে বা দখলে সহযোগিতা করছে। একই সঙ্গে চাঁদাবাজি করছে ভবন নির্মাতা ঠিকাদার, রাস্তাঘাট নির্মাতা ঠিকাদার, মার্কেটের দোকানদার, ফুটপাতের হকার ইত্যাদির কাছ থেকে। গত শুক্রবার এলিফ্যান্ট রোডে দু’জন ব্যবসায়ীকে কুপিয়েছে সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না পেয়ে এভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগার অথবা বিদেশ থেকে এতদিন আন্ডার ওয়ার্ল্ডে সক্রিয় থেকেছে। এখন তাদের ৬ জন কারাগার থেকে মুক্তি পয়েছে। মুক্ত হয়েই তারা সরেজমিনে কাজে লেগে পড়েছে। এদের একজন হাজারিবাগের ইমন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়েছে ইমনের ক্যাডাররা। অপর দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহম্মদপুরের পিচ্চি হেলাল ও মিরপুরের শাহাদতের ক্যাডাররা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধের অভয়ক্ষেত্র হিসাবে ইতোমধ্যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে মোহম্মদপুর-মিরপুর। অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যে বসে নেই, সেটা সহজেই বুঝা যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অপরাধী চক্রগুলোর জন্য এখন সুসময়। স্বৈরাচার বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এ সরকার অরাজনৈতিক হওয়ায় দুর্বল সরকার। এও কারো অজানা নেই পতিত স্বৈরাচারের দোসর পুলিশ বাহিনী ছাত্র-জনতার রোষের শিকার হয়েছে। তার নৈতিক বল ও মনোবল কমে গেছে। পুলিশ বাহিনী এখনো অনেকটাই নিষ্ক্রীয়। এমতাবস্থায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে সামনে খোলা ময়দান পেয়ে গেছে। অন্যান্য অপরাধী চক্রও অনুরূপ সুযোগ পেয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতির এটা অন্যতম বড় কারণ। গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার মগবাজারে সাড়ে ১৬ লাখ টাকায় একটি ভবন ভাঙার কাজ পান একজন ঠিকাদার। এর কিছুদিন পরই স্থানীয় গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য ঘটনাস্থলে এসে কাজ চালিয়ে যেতে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। আগের চেয়ে চাঁদাবাজির পরিমাণ ও ধরণ পাল্টে গেছে। গত কয়েক মাস ধরে শীর্ষ অপরাধীদের নামে নজিরবিহীনভাবে চড়া টাকা চাঁদা দাবি করায় পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে একই ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়ায়, ঢাকার ব্যবসাক্ষেত্রে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। নির্মাণ খাতের ঠিকাদারদের হুমকির মুখে বেতন দিতে বা কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে অন্যান্য খাতের ব্যবসায়ীদের অপহরণ বা হামলার শিকার হতে হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা এবং ভুক্তভোগীরা বলছেন, গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিছু শীর্ষ অপরাধীর মুক্তি উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। চাঁদাবাজির ঘটনায় ২০০১ সালে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত ২৩ জনের মধ্যে সুব্রতের মতো অপরাধীদের নামও উঠে এসেছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছে আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সানজিদুল হাসান ইমন এবং ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের নাম। সুব্রতর গ্যাং মগবাজার, মালিবাগ, ইস্কাটনসহ আশেপাশের এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। আব্বাস মিরপুর, কাফরুল এবং ভাষানটেক এলাকায়, ধানমন্ডিতে ইমন নিউমার্কেট এবং মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় এবং মোহাম্মদপুর এবং আগারগাঁওয়ে হেলাল গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।তাদের মধ্যে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় হেলালের নামও রয়েছে।তৎকালীন ছাত্রদল নেতা হেলালকে ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের ১৬ আগস্ট তিনি জামিনে মুক্তি পান। সর্বশেষ ঘটনায়, গত ১০ জানুয়ারি রাতে এলিফ্যান্ট রোডে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করে ইমন গ্যাং। এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির (ইসিএস) সভাপতি ওয়াহেদুলের পাশাপাশি, মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হককেও মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে প্রায় ২০ জনের একটি দল কুপিয়ে আহত করে। ইসিএস সভাপতি ওয়াহেদুল বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর তাদের যে নির্বাচন হয়েছে তার কয়েকদিন আগে তিনি চঞ্চল নামে পরিচয় দেওয়া একজনের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছিলেন।কথোপকথনের সময়, ইমন নামে পরিচিত আরেকজন ব্যক্তি ফোন কলে যোগ দেন এবং আমার কাছ থেকে মাসিক টাকা দাবি করেন কিন্তু আমি টাকা দেব না বলে জানাই। তিনি কথা না বাড়িয়ে ফোন কলটি কেটে দেন।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, অনেকেই দেখেছে, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক দল বিশেষ ক্ষমতাসীন দলের একটা নিকট সম্পর্ক থাকে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক থাকে ওতপ্রোত। বিগত স্বৈরাচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অর্থলুট, পাচার ইত্যাদির মহোৎসব চলেছে। এখন গোটা দেশ ও জাতিকে সেই অপশাসন, দুঃশাসন ও মাফিয়া শাসনের খেসারত গুনতে হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শাসন অবসানের জন্যই ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে। তারা আর কখনো ওই ধরনের শাসন দেখতে চায় না। তারা চায় নতুন বাংলাদেশ দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, অন্যায়, অপকর্ম, লুণ্ঠন ও পাচার মুক্ত হবে। যেখানে সবাই মানবিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক অধিকার পাবে, নিরাপত্তা পাবে, সুশাসন ও আইনের শাসন লাভের অধিকারী হবে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ছাত্র-জনতার এই চাওয়া ও প্রত্যাশা যেন অসম্ভবপর হয়ে উঠতে যাচ্ছে। পুরানো বয়ান-বচন যেমন ফিরে আসছে, তেমনি সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদিও ফিরে আসছে। সংস্কার রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার বাহানা পুনঃপুন উচ্চারিত হচ্ছে। আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করছি, পতিত স্বৈরাচারের দ্বারা যে দুটি দল সবচেয়ে বেশি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, বিএনপি তার একটি। স্বাভাবিক ও সঙ্গত কারণেই দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসাবে আগামী নির্বাচন যখনই হোক, বিএনপিরই জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের যেন আর তর সইছে না। এটা যেমন একটি দিক, অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার আহ্বান জানালেও বিএনপির নেতাকর্মীরা তার তোয়াক্কা করছেন না। জমি-প্রতিষ্ঠান দখল থেকে আরম্ভ করে পরিবহনসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে চাঁদাবাজিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের নাম উচ্চারিত না হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিএনপির নামেও এসব অপকর্ম হচ্ছে, যা এতদিন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ করেছে, তাই এখন বিএনপি বা তার কোনো সহযোগী সংগঠন করবে অথবা তাদের নামে অন্যকেউ করবে, তা হতে পারে না। এটা কেবল অনভিপ্রেত নয়, দুঃখজনকও। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উচিত বিষয়টি আমলে নেয়া ও যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। দেশের বর্তমান অবস্থাকে ওলটপালট করে দেয়ার জন্য পতিত স্বৈরাচার শুরু থেকেই সক্রিয়। তাকে অন্ধ মদদ দিয়ে যাচ্ছে মোদির ভারত। এখন দেশের প্রধান সমস্যা আইন-শৃঙ্খলাজনিত এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই দু’ ক্ষেত্রেই পতিত স্বৈরাচারের দোসরা নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এর মোকাবিলায় সরকার পেরে উঠছে না। অভাব-দারিদ্র্য থাকলে অপরাধী বাড়ে। দারিদ্র্য মোচন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এর প্রতিকারের একমাত্র উপায়। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়; বিশেষ করে, যখন পুলিশের উদ্যম ও মনোবল একেবারে তলানিতে। সরকারকে এ ব্যাপারে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে সেনাবাহিনীকে। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতাও সরকার চাইতে পারে। দেশের কোথায় কারা সন্ত্রাস, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি করছে সেটা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সবাইকে আইনামলে আনার বন্দোবস্ত করতে হবে। আইনশৃংখলায় উন্নয়নে ছাত্রসমাজ ও ছাত্র-সমন্বয়করাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে দেখে এর সমাধানে জাতীয়ভাবে তৎপর হতে হবে। জনমনে স্বস্তি ফেরাতে হলে, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ ব্যাপারে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।