বাংলাদেশে প্রধান ফসল ধান। এর প্রধান মৌসুম বোরো এবং অন্যটি হচ্ছে আমন। সেই আমন ধানের কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমে বাড়ছে চালের দাম। বাজারে মোটা চাল কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা আর চিকন চাল কেজি প্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত। যে হারে বাড়ছে তাতে এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অল্প কিছুদিন পরে হয়তো চালের কেজি সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যাবে। কিটিসিবির তথ্য মতে, গত এক মাসে সরু চালে ৪ শতাংশ, মাঝারি চালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও মোটা চালে ৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে গড়ে সব ধরনের চালের কেজিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। চালের মূল্য আরো বাড়বে বলে জনমনে আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ, একই সময়ে চাল রফতানিকারী এশিয়ার দেশগুলোতে চালের দাম কমেছে। বর্তমানে চালের মূল্য ভিয়েতনামে প্রতি টন ২১৭ মার্কিন ডলার, ভারতে ৪৯৭ ও থাইল্যান্ডে ৫০২ ডলার। এছাড়া, বিটিটিসির তথ্য মতে, গত এক বছরে চালের দাম বাংলাদেশে বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, আর আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরমধ্যে ভরা মৌসুমে দেশে চালের মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের সংসার চালোনো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেই খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। তাতে পুষ্টিহীনতার হার বাড়ছে। কয়েক বছর যাবত দেশে মূল্যস্ফীতির হার বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক চলেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কতিপয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার, যা কার্যকর হয়নি! মূল্যস্ফীতির বিষয়টি সর্বত্রই ব্যাপক আলোচিত। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও এ সময়ে মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়নি। বরং শিল্প-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু বেকারত্ব বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়েছে। তাই মানুষ অনেক দিন থেকে প্রয়োজন মতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। বিবিএসর তথ্য মতে, ‘২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি মজুরি বৃদ্ধির হার। এই সময়ে গড়ে যত মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বাজার থেকে নিত্যদিনের পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য কমেছে।’ বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, ‘বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সক্ষমতা নেই’। ফলে পুষ্টিহীনতার হার অনেক বেড়েছে, যা শান্তি ও উন্নতির বড় অন্তরায়! এই পরিস্থিতিতে আসন্ন পবিত্র রমজানের সময়ে পণ্যমূল্য নিয়ে মানুষের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা আরও বাড়ছে। এই অবস্থায় আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী সরকার গত ৯ জানুয়ারি দু’টি অধ্যাদেশের মাধ্যমে শতাধিক পণ্যের আমদানি শুল্ক ও সেবার ব্যয় বৃদ্ধি করেছে, যা মানুষের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘার শামিল। খাদ্য ও বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শতাধিক পণ্যের শুল্ক ও সেবার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পণ্যমূল্য বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে সব পণ্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এই শুল্ক বৃদ্ধি ও সেবার ব্যয় বৃদ্ধি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। ভ্যাট না বাড়িয়ে সরকারি অপচয় ও খরচ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিশেষ ঋণ গ্রহণ করেছিল অনেক কঠিন শর্তে তথা কর-জিডিপির হার বৃদ্ধি করার শর্তে। তার কঠোর সমালোচনা হয়েছিল সব মহল থেকেই। কিন্তু উক্ত ঋণ না নিলে দেশ আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যেতো, যা দেশের জন্য চরম ক্ষতিকারক হতো। আর উক্ত ঋণের কর-জিডিপির হার বৃদ্ধির তথা ভর্তুকি কমানোর শর্তের কারণেই তখন জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। ফলে পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছিল। এখন বৃদ্ধি করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পণ্যের আমদানি শুল্ক ও সেবার ব্যয়। ভবিষ্যতে কৃষি খাতের ভর্তুকি কমাতে হবে উক্ত ঋণের শর্ত অনুযায়ীই! সেটা হলে কৃষি উৎপাদনের ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পাবে। উপরন্তু বর্তমান সরকার এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার আবেদন করেছে আইএমএফ’র কাছে। এটা পেলে তাতেও কঠিন শর্ত থাকবে মনে হয়! সে বিষয় যাই হোক, বর্তমান আমনের মৌসুমে চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য ছোট ব্যবসায়ী বড় ব্যবসায়ীকে দায়ী করছে। আর বড় ব্যবসায়ী চাল কলের মালিককে দায়ী করেছে। অপরদিকে, চলতি বছর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে পৃথকভাবে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফসলহানিকে দায়ী করছেন অনেকে। আবার অনেকে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন। মার্কিন কৃষি বিভাগের মতে, বাংলাদেশে ওই বন্যায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন কম হয়েছে। দেশের কৃষি বিভাগের মতে, বন্যার কারণে ধান-চাল উৎপাদনের টার্গেট পূরণ হয়নি। দ্বিতীয়ত: সরকার মজুদ বৃদ্ধি করার জন্য ধান-চাল ক্রয় করছে। এসব বিভিন্ন কারণে আমন ধানের ভরা মওসুমে চালের মূল্য বেড়েছে। অবশ্য চালের ঘাটতি পূরণ ও মূল্য স্বাভাবিক করার জন্য সরকার আমদানি শুল্ক ৬৩ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করেছে। উপরন্তু প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু চাল দেশে এসেছেও। বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হচ্ছে। তবুও চালের মূল্য বেড়েই চলেছে। ফলে মানুষের জীবন ধারণ দুর্বিষহ অবস্থাতেই রয়েছে। চালের মূল্য কমিয়ে মানুষের কষ্ট কমাতে হবে এবং তা সরকারিভাবে। নতুবা দেশের জন্য মহা কল্যাণকর সংস্কার বাস্তবায়নও তিতা লাগবে মানুষের কাছে। চালের মূল্য কমানোর লক্ষ্যে সরকারিভাবে ঘাটতি চাল আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রয় করতে হবে চাহিদা মাফিক। এ বছর চালের ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে বন্যাজনিত ১২-১৩ লাখ মেট্রিক টন কম উৎপাদন এবং স্বাভাবিক ঘাটতি বার্ষিক ৬-৭ লাখ মেট্রিক টন। সাকুল্যে ২০ লাখ মেট্রিক টন চাল ঘাটতি হতে পারে, যার সবটাই সরকারিভাবে আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রয় করতে হবে। বেসরকারিভাবে শুল্কমুক্তভাবে আমদানিকৃত চালে মানুষ তেমন কোনো সুফল পাবে না। সুফল শুধু ব্যবসায়ীরাই ভোগ করবে। যেমন: মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য অনেক পণ্যের আমদানি শুল্ক কম/মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো পণ্যের মূল্যই কমেনি। শুল্কমুক্ত করার সুফল ভোগ করেছে ও করছে ব্যবসায়ীরা! চালের ক্ষেত্রেও তাই হবে। তাই ঘাটতি চাল সরকারিভাবেই আমদানি করতে হবে এবং তা ভর্তুকি মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রয় করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে চাল পৌঁছানোর অন্যতম পথ হচ্ছে, ফ্যামেলি কার্ড, টিসিবির ট্রাক সেল এবং শিল্পাঞ্চলসহ সারা দেশের শ্রমিক ও গরিব মানুষের কাছে কার্ডের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে চালসহ সব নিত্য পণ্য সরবরাহ করা। খাদ্য উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, ‘ওএমএস’র সুবিধা বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রতি উপজেলায় দুই টন করে চাল দেয়া হয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে আগামী দুই মাস দেশের ৫০ লাখ উপকারভোগী মাত্র ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি করে চাল পাবে। এটা ভালো উদ্যোগ। তাই উপকারভোগীর সংখ্যা ও সময় বৃদ্ধি করা দরকার। এসব হলে বাজারে চালসহ নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে যাবে। তখন বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরাও পণ্যমূল্য কমাবে। ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমে গিয়ে স্বাভাবিক হবে। সরকারকে নিয়মিত বাজার তদারকির মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় নিশ্চিত করতে হবে। অপরদিকে, আসন্ন গম এবং ইরি-বোরো মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, গম এবং ইরি-বোরো ধানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে গম ও চালের ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। সে কারণেও মূল্য বেড়ে যাবে। তাই গম এবং ইরি-বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। সে জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ স্বল্প মূল্যে ও যথাসময়ে কৃষকের কাছে পৌঁছানো আবশ্যক। সর্বোপরি আসন্ন পবিত্র রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের যেমন নাভিঃশ্বাস উঠেছে, তেমনি এখন সবজির মূল্য খুব কম হওয়ায় কৃষকের লোকসান হচ্ছে। সবজির দাম ঠিক-মতো না পাওয়ায় কিংবা বিক্রি না হওয়ায় কোথাও কোথাও কৃষক তার সবজি গরু ছাগলকে খাওয়াচ্ছে! সবজির বাম্পার ফলন হওয়ায় এবং অতিরিক্ত সবজি সংরক্ষণ করার তেমন ব্যবস্থা দেশে না থাকায় কৃষকরা বিগত দিনের ন্যায় এ বছরও সবজি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। ফলে কৃষক উৎপাদনে নিরুৎসাহী হয়ে উঠতে পারে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য চরম ক্ষতিকর।তাই কৃষকের সব ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। নজর দিতে হবে বাজার তদারকিতে। যাতে মধ্যস্বত্ব ভোগী ও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।