রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সজ্ঞা মতে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি আছে কিন্তু আদর্শ নেই। দেশের রাজনীতিতে আদর্শের মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ হলো বস্তুবাদী চেতনার বিস্তার বা আধিক্য। বস্তুবাদী মানুষের কাছে আদর্শের বিষয় হচ্ছে অর্থ। এক্ষেত্রে মাথাপিছু আয়, বণ্টনব্যবস্থার সমস্যা, বৈষম্য এসবই গৌণ হয়ে পড়ে। বস্তুবাদী সমাজকে খুশি রাখতে এবং বস্তুবাদী মানুষের ভোট পেতে রাষ্ট্র নাগরিককে প্রত্যক্ষ অর্থ-সাহায্য কিংবা সুনির্দিষ্ট আর্থিক উপযোগিতাসম্পন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করে। কেননা, তা-ই মানুষের পছন্দ এবং তাতেই মানুষ তাদের ভোট দেবে। বস্তুনিরপেক্ষ আদর্শিক রাজনীতি আর এ বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। রাজনীতিতে তাই আদর্শের আর কোনো স্থান থাকছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোনো আদর্শের কথা কেউ জানতে চায় না এখন। এখানে আদর্শের হাত ধরে রাজনীতি করারও কোনো সুযোগ নেই বর্তমানে। আদর্শের কথা বলে, ব্যাখ্যা করে, আদর্শের পথে হাজার মাইল পথ হেঁটে এখন আর এখানে কেউ নেতা তৈরি হতে পারে না কিংবা কোনো নেতাকর্মী জোগাড় করতে পারে না। কর্মী সমর্থক শুধু তাকিয়ে থাকে-কোথায় গেলে, কোন পথে গেলে তাদের ভোগবাদী আকাক্সক্ষার ভালো জোগান হবে। রাজনীতিতে তাই জ্ঞানচর্চার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এহেন রাজনীতিতে শুধু চলে অর্থের খেলা। তাই অর্থশালী মানুষই রাজনীতির মাঠে ভিড় জমায়। অর্থ দিয়ে কিনে নেওয়া যায় মানুষের জমায়েত, মানুষের ভোট। আদর্শবাদী গরিব নেতা কোনো একসময় ছিটকে পড়ে রাজনীতির সাইড ট্র্যাকে। তাই তো বাংলাদেশের মতো রাজনীতিসচেতন মানুষের মাঝেও ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং বিত্তশালী শ্রেণি রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল তার আদর্শ অনুযায়ী লোকজনদেরকে শিক্ষিত ও দীক্ষিত করে তোলে। বস্তবাদী ও উদ্দেশ্যবাদী রাজনৈতিক দলগুলো নেতাকর্মীর মন-মগজ তৈরি করতে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি একটি ব্যতিক্রম। জিয়াউর রহমান নিজে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তাকে বলা হয় সৈনিক থেকে রাজনীতিক।জিয়াউর রহমানের বিষয়ে সামান্য পড়াশোনা করে এটুকু বুঝেছি যে, তিনি একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। নেতাকর্মীদের সৎভাবে, সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এসব কর্মসূচিতে তিনি নিজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। নেতাকর্মীরা যাতে লোভী, স্বার্থপর ও সন্ত্রাসী না হয়ে ওঠে সেজন্য তিনি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতেন। বক্তৃতাপূর্বক তার নিজের লেখা নোট থেকে দেখা যায় যে, তিনি নেতাকর্মীদের ‘খাই খাই রব’এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সবাই জানেন যে, জিয়াউর রহমানের সততা ছিল অভাবিত ও অকল্পনীয়। এ নিয়ে অনেক বাস্তব গল্প আছে। তিনি চাইতেন তার নেতাকর্মীরাও তার মতো সহজ, সরল, স্বাভাবিক ও সৎ জীবনের অধিকারী হোক। জিয়াউর রহমান যে একজন বাগ-চাতুর্যপূর্ণ নেতার বিপরীতে মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার কারণ এমনই। এক জিয়া লোকান্তরিত হওয়ার পর ঘরে ঘরে যেভাবে লাখ লাখ জিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ তার অনুসৃত জীবন ও তার অমলিন আদর্শ। তাই আওয়ামী নেতৃত্ব সবসময়ই জিয়াউর রহমান ও তার উত্তরাধিকারকে তাদের ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ মনে করেছে। জিয়ার নাম-ধাম ও আর্দর্শকে মুছে দিতে চেয়েছে। কিন্তু জিয়ার আদর্শ মুছে যায়নি বরং তারাই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। এটা আশা ও আনন্দের কথা যে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারে সেসব আদর্শ-উদ্দেশ্যের সংযোজন ঘটেছে।
শহীদ জিয়াউর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার ও আদর্শের উত্তরাধিকার সেই তারেক রহমান একটি আহ্বান জানিয়েছেন। কয়েক দিন আগে দলকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করতে মেধাবী ও ভালো মানুষদের সামনে আনার জন্য নেত-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের ভালো মানুষ দরকার। কারণ, এই রাষ্ট্রকে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার ধ্বংস করে দিয়েছে, অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। কাজেই আমাদের দলকে যদি পুনর্গঠন করতে হয় সেরকম মানুষ দরকার। সেরকম মানুষকে বের করে নিয়ে আসা হবে। বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধনকালে তারেক রহমান এ কথা বলেন। তিনি লন্ডন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। এ প্রসঙ্গে দলের প্রস্তাবিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণের সমর্থন পাওয়ার দেশ পুনর্গঠন করতে হবে। দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য আমরা ৩১ দফা দেশের সামনে, মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছি। সেটি যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, অবশ্যই মেধাবী পরিশ্রমী, সৎ মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব (তারেক রহমান) উদ্যোগ নিবেন, এখন প্রতিটি উপজেলা এবং জেলায় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিএনপিকে আদর্শ দলে পরিণত করতে হবে। সৎ ও মেধাবী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। জিয়াউর রহমান নিজের অতুলনীয় সৎ জীবনের সাথে সাথে শাসনব্যবস্থায়ও সৎ নিষ্ঠা ও সেবার আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তার আমলের উপদেষ্টা পরিষদ কিংবা মন্ত্রিপরিষদের দিকে নজর দিলেই তার প্রমাণ মেলে। তার পরিষদের মানুষেরা ছিলেন সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। যারা বিএনপির প্রাথমিক ইতিহাসের কথা জানেন তারা সবাই স্বীকার করবেন যে, সারা দেশে তিনি সৎ মানুষ, সাহসী মানুষ ও নিষ্ঠাবান মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছেন। স্থানীয় পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এসব সৎ লোকেরা নির্মাণ করেছিল বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এর প্রমাণ মেলে ১৯৯১ সালের বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের লোকেরা মুজিব কোট কেটে অপেক্ষা করছিল মন্ত্রী, আধামন্ত্রী ও পাতিমন্ত্রী হওয়ার। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সারা দেশের মানুষ ভোট দিয়েছে বিএনপিকে। এর জন্য যেমন বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের সুষমা কাজ করেছে, তেমনি শহীদ জিয়ার সততা ও আদর্শের উত্তরাধিকার আরও বেশি কাজ করেছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে কম বেশি শহীদ জিয়ার আদর্শ অনুসৃত হয়েছে। এখন আবার শহীদ জিয়ার সততা ও মেধা বিকাশে তারেক রহমানের আহ্বান ও উদ্যোগ জাকিতে আশান্বিত করেছে। অস্বীকার করে লাভ নেই যে, ইতোমধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় প্রবাহিত হয়েছে অনেক পানি, আর বিএনপিকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক নিপীড়ন, নির্যাতন ও নির্মমতা। বিগত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপির টিকে যাওয়া একটি অনন্য ঘটনা। যেভাবে নেতাকর্মীরা লোভ-লালসা ও ভীতিকে অতিক্রম করে বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তা স্মরণযোগ্য। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সেই ভূমিকার বিপরীতে বিজয়ের পর পর বিএনপির কিছু বিপথগামী লোকের কারণে বিএনপি বদনামের শিকার হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশনা ছিল সর্বোচ্চ ত্যাগের। কিছু লোক ত্যাগের বিপরীতে ভোগের জগতে বিচরণ করেছে। যে কোনো মূল্যে দেশে সম্প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ১৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিত করা হয়েছে। তারপরও সারা দেশ থেকে এখনো অভিযোগ আসছে। এই প্রেক্ষিতে তারেক রহমানের বিএনপি পুনর্গঠনের কথা প্রাসঙ্গিক ও সময়োচিত। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল তার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি অনুযায়ী কর্মী ও নেতৃত্বকে গড়ে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। ডান ও বাম ধারার রাজনৈতিক দল যেমন জামায়াতে ইসলামী ও কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে কর্মী ও নেতাদের বিভিন্ন পর্যায়ে দীক্ষিত করার নিয়ম-রীতি রয়েছে। যদিও বিএনপি সে রকম আদর্শবাদী দল নয়। আমরা বলি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম হচ্ছে সেই জিয়াউর রহমানের পার্টি দর্শন। দীর্ঘ বছরগুলোতে বিএনপি হামলা-মামলা ও গুম-খুনের মোকাবেলা করায় নিজেদের দিকে নজর দিতে পারেননি। এখন এটা অভিনন্দনযোগ্য সিদ্ধান্ত যে বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান তাদের নেতাকর্মীদের শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে মন ও মানস তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।সৎলোকের শাসন বা সৎলোকের নেতৃত্ব একটি জাতির অন্যতম চাওয়া। কারণ অসৎ ব্যক্তির কাছে শাসনভার পড়লে সেই ব্যক্তি জনগণের ওপর জুলুম করার পাশাপাশি অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা এই সত্যতা উপলব্ধি করেছি।বস্তুত বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রে সততার বড়ই অভাব। সততাই বিবেকের অপর নাম। এটাই মানুষের নৈতিক সত্তা। মানুষের দেহ হলো বস্তুসত্তা। দেহের ভালো-মন্দের কোনো ধারণা নেই। সৎলোক তারাই, যারা বিবেকের দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ তারা বিবেকের বিরুদ্ধে চলে না। সৎলোক আসমান থেকে রেডিমেড নাজিল হয় না। বিদেশ থেকে আমদানি করে আনার জিনিসও এটি নয়। সুপরিকল্পিত উপায়েই সৎলোক তৈরি করতে হয়।সেই পরিকল্পনারই অংশ তারেক রহমানের ভালো মানুষ গড়ার ঘোষণা। বিএনপিকে পুর্নগঠনের মাধ্যমে সৎ ও মেধাবী নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এটাই সবার প্রত্যাশা।