নওগাঁ প্রতিনিধি
দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের ভারত সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় বেড়েছে গরু চোরাচালান। এতে এক দিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে অন্যদিকে এলাকায় বিএসএফের হাতে বাড়ছে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা।
কোরবানি ঈদ সামনে রেখে ইতোমধ্যেই সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারীরা আগে ভাগেই অবস্থান নিয়েছেন। ভারত থেকে অবৈধভাবে গরু আনতে তারা টাকা লোভ দেখিয়ে কিম্বা সুদের প্যাচে ফেলে সম্পৃক্ত করছেন স্থানীয়দের যুবকদের। মাঝে মধ্যেই সীমান্তে বিএসএফের হাতে আহত হচ্ছেন, প্রাণ যাচ্ছে কারো কারো। গরু পাচার
অভিযোগ উঠেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ভূমিকা নিয়েও। বিজিবি সদস্যরা নামেমাত্র পাহারা দিচ্ছেন সীমান্ত। বাস্তবতা হলো গরু প্রতি তাদের পকেটে আসছে হাজার থেকে পনেরশো টাকা করে। তাই অনেকটা নিশ্চুপ থাকছেন তারা। অন্যদিকে, থানা পুলিশ চাঁদায় আদায় করতে সীমান্তে রেখেছেন প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন স্থানীয় দালাল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর জুড়েই জেলার সাপাহার ও পোরশা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে রাতের আঁধারে আনা হয় ভারতীয় গরু। সপ্তাহ খানেক হলো সেই চোরাচালানী বেড়েছে অন্তত ৫ থেকে ৭ গুণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাপহার উপজেলার কিষ্ণসোধা, কলমুডাঙ্গা, হাঁপানিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে আস্তানা গেড়েছেন জেলা ও জেলার বাইরের অন্তত অর্ধশত গরু ব্যবসায়ী। স্থানীয়দের কাছে তারা মহাজন হিসেবে পরিচিত।
কলমুডাঙ্গা গ্রামের নজিবর রহমান নামে এক ব্যক্তি জানান, সীমান্তের গ্রামগুলোতে মানুষের মুখে মুখে এখন দিনরাত শুধু একটিই আলাপ-আলোচনা, সেটি হলো-সীমান্ত পার করে কে আনলো কয়টি গরু। কখন আসবে সিগন্যাল? আবারও যাওয়া হবে কখন?
মুখে মুখে সহজেই প্রতি নিয়তই পাওয়া যাচ্ছে বিএসএফের টহলের খবর। মোবাইলের মাধ্যমে খবর আদান প্রদান করছেন ভারতে অবস্থারত সেদেশের গরু ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ীরা। এলাকায় গেলে এখন সর্বোত্রই এরকম চিত্র চোখে পড়বে।
তিনি জানান, গরু ব্যবসায়ীদের টার্গেট থাকে এলাকার যুবকদের প্রতি। টাকার লোভ দেখিয়ে যুবকদের রাখাল বানিয়ে সীমান্তে পাঠায় গরু আনতে। আবার সুদের টাকার প্যাচে ফেলেও বাধ্য করে অনেক সময়। অভিজ্ঞ রাখালদের পাশাপাশি দু’চার জন করে নতুন রাখাল পাঠানো হয় এক একটি দলে।
সীমান্তে বিএসএফ টহলের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য গরু ব্যবসায়ীরা একেকটি এলাকায় নিয়োগ করেছেন ৪ থেকে ৭ জন করে দালাল। সন্ধ্যা হলেই প্রস্তুত রাখা হয় রাখালদের।
তিনি আরো জানান, দালালদের কাছ থেকে সিগন্যাল পেয়ে রাতের আঁধারে একই সঙ্গে আড়াই থেকে তিনশো রাখাল ঢুকে পরছেন ভারতে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই গরু নিয়ে তারা আবার ফিরে আসছেন। এর মধ্যে অনেকে বিএসএফের হাতে আটক হয়ে আহত ও মারাও যাচ্ছেন কেউ কেউ।
কৃষ্ণসোধা গ্রামের আবুল ফজেল (ছদ্ম নাম) নামে এক রাখাল জানান, ভারত থেকে গরু আনতে পারলেই মহাজনরা নগদে দিচ্ছেন গরু প্রতি দুই হাজার টাকা। কোনো রকমে ওপারে (ভারতে) যাওয়া এবং সেখান থেকে সে দেশের রাখালদের কাছে টোকেন বুঝে দিয়ে গরু আনতে পারলেই কাজ শেষ। একসঙ্গে তারা ৪ থেকে ৫টি করে গরু আনেন।
কলমুডাঙ্গা গ্রামের গরু ব্যবসায়ী মাহবুর রহমান জানান, জেলার প্রতিটি সীমান্ত এলাকায় রয়েছে থানা পুলিশ ও বিজিবির দালাল। এদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করেন পুলিশ ও বিজিবি। গরু প্রতি বিজিবি পায় ৫০০ আর পুলিশ পায় ২০০। এছাড়া লাইনম্যান ও দালালদের পেছনে খরচ হয় আরও এক হাজার টাকা।
তিনি জানান, কলমুডাঙ্গা সীমান্তে গত কয়েক বছর ধরে বিজিবির নাম করে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে চাঁদার টাকা আদায় করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী জিয়া নামে এক ব্যক্তি। তিনি কলমুডাঙ্গা গ্রামের নওশাদের ছেলে। সাপাহার থানা পুলিশের নামে চাঁদা তুলছেন আব্দুল করিম। এদের এই কাজে প্রতিবাদ করার কেউ নেই। প্রতিবাদ করতে গেলে হতে হয় পুলিশি হয়রানি।
স্থানীয়রা জানান, চাঁদার টাকা ভাগ পেয়ে পুলিশ ও বিজিবির কর্তা ব্যক্তিরা গরু চোরাচালানকে নিরুৎসাহিত করার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন। ফলে দিন দিন চোরাচালানি বাড়ছে। বাড়ছে সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা।
সীমান্তে গরু চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে গত ৫ বছড়ে জেলায় কতজন আহত, পুঙ্গু ও নিহত হয়েছেন সেই তথ্য দিতে পারেনি বিজিবি। তবে স্থানীয়রা বলছেন গত পাঁচ বছরে বিএসএফের হাতে নওগাঁ সীমান্তে প্রাণ গেছে প্রায় ৩০ জন রাখালের। পুঙ্গু হয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন অন্তত ৫০ জন।
সাপাহার উপজেলা সদরের বাসিন্দা আশরাফ আলী, কাজল, আরব আলী জানান, বিএসএফ সদস্যদের হাতে নির্যাতনের সব শেষ ঘটনা ঘটে ২১ অক্টোবর । ওই দিন ভোরে রাখালদের সঙ্গে সীমান্তে কোরবানির গরু আনতে গিয়ে বিএসএফ সদস্যদের হাতে নির্যাতনের পর নিখোঁজ হন কলমুডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম নূরু (৩৭)। ৪দিন পর মঙ্গলবার সকালে তার লাশ পাওয়া যায়।
এছাড়া সপ্তাহ খানেক আগে একই এলাকার মামিনুল (২০) ও ইসহাক আলী (১৯) নামে দুই যুবকে হত্যা করে বিএসএফ।
২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া সীমান্তে ফারুক হোসেন (২৭) নামে এক যুকবকে নির্যাতন হত্যা করে বিএসএফ। ঘটনাটি সেসময় তোলপার সৃষ্টি করে সব মহলে।
এ বিষয়ে ১৪ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (পত্নীতলা) কমান্ডিং অফিসার সাঈফ জানান, নওগাঁ সীমান্তে ২০১৪ সালে কোনো বাংলাদেশির প্রাণ যায়নি। তবে এ বছর মোট ৬ জনকে আটক করে ভারতীয় পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে বিএসএফ।
তিনি জানান, বিএসএফ এখন আর আগের মতো গুলি করে হত্যা করেন না। তারা এখন পাথর নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ ও আটক করে নির্যাতন করে।
তিনি আরো জানান, অল্প সংখ্যক বিজিবি সদস্য দিয়ে সাপাহারের প্রায় ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার সীমান্ত পাহাড়া দেয়া অসম্ভব ব্যাপার। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা ও সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলেই কেবল সীমান্তের চোরাচালান ও একইসঙ্গে বিএসএফের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব।