ঢাকাশনিবার , ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও অন্যান্য
  5. খেলাধুলা
  6. গল্প ও কবিতা
  7. জাতীয়
  8. তথ্যপ্রযুক্তি
  9. দেশজুড়ে
  10. ধর্ম ও জীবন
  11. প্রবাস
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. বিশেষ প্রতিবেদন
  15. মুক্তমত
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সুনীলের কবিতা, কবিতায় সুনীল

দৈনিক পাঞ্জেরী
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪ ১২:৫৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

লেখক: অঞ্জন আচার্য

সুনীলের কবিতা, কবিতায় সুনীল {focus_keyword} সুনীলের কবিতা, কবিতায় সুনীল (পর্ব-১) 1133‘নিজের কবিতা বিষয়ে কিছু লেখা এক বিড়ম্বনা মাত্র। তাতে প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় যে, আমার কবিতার বিশেষ কিছু মূল্য আছে। আমি নিজে বিশ্বাস করি, এতদিন শুধু কবিতা রচনার চর্চা করেছি মাত্র, আসল কবিতা এখনও লেখা হয়নি। এক অসম্ভব অতৃপ্তি ও যাতনা – যা অন্য কারুর পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব- আমাকে একটি নতুন কবিতা লিখতে বাধ্য করে। সেটি শেষ করার পরই সেই অতৃপ্তি ও যাতনা আবার শুরু হয়। চিকিৎসার অতীত ক্ষয়রোগের মতন এরা আমার সারা জীবনের সঙ্গী থাকবে।’
সুনীল সম্পর্কে সুনীলের রচনায় এভাবেই কবি সুনীলকে আয়নার সামনে দাঁড় করান ব্যক্তি সুনীল। এই ক্ষয়রোগ প্রতিটি কবিকেই হয়তো বহন করতে হয়। সুনীলও এর বাইরের কেউ নন। তিনি বহন করেছিলেন, আর করেছিলেন বলেই তিনি প্রধানত কবি; তারপর অন্য কিছু। এ-কথার গ্রহণযোগ্যতা মেলে সুনীলকে নিয়ে লেখা কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি সমালোচনা-নিবন্ধে। তার মতে, ‘কবিতা লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল নেশা। গল্প, উপন্যাস লেখা ছিল তার (সুনীল) পেশা বা কাজ।’ (‘ভ্রাম্যমাণ লেখকের স্মৃতিসঞ্চয়’, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বইয়ের দেশ, এপ্রিল-জুন ২০১০, পৃ ৩৭)। অর্থাৎ অর্থের জন্য সাহিত্যের নানাবিধ শাখায় বিচরণ করলেও কবিতার অঙ্গনটি ছিল সুনীলের একান্ত আপন। বলতে গেলে সেই রহস্য গভীর গোপন।
১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকা। সেখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় সুনীলের কবিতা। দেশের বয়স তখন ১৮। আর কবির বয়স ছিল ১৭। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। তখনো কবির নামের পেছনে ঝুলে ছিল ‘কুমার’ শব্দটি। এরপর ১৫ জানুয়ারি ১৯৫৫ সংখ্যায় ‘কুমার’ শব্দটি খসে পড়ে কবির নাম থেকে। নাম হয় শুধুই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথম লেখাটি ছিল এক কিশোরীর মন পাওয়ার আশায় রচিত। কারণ সুনীল জানতেন, সেই কিশোরীর বাসায় অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে রাখা হতো দেশ পত্রিকাটি। তাই তার মন পাওয়ার জন্য অথবা নিজের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার জন্য বের করলেন অভিনব এক বুদ্ধি। নিজেকে কবি হিসেবে কিশোরীর কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে একরকম পথ বেছে নেন তিনি। সুনীলের নিজের কথায়- ‘একটি রচনা ঝোঁকের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। কবি-খ্যাতির আশায় নয়, শুনেছিলাম, কোনো লেখা ছাপা হলে সেই পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সত্যিই ডাকযোগে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্যাকেট পেলাম। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৫১ সালের কোনো এক মাসের ‘দেশ’ পত্রিকায়, কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’ (দেশ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক হর্ষ দত্তের হিসাবমতে ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যা; সূত্র : প্রিয় ‘দেশ’, প্রিয় ‘মানুষ’, হর্ষ দত্ত, দেশ, ১৬ কার্তিক ১৪১৯, ২ নভেম্বর ২০১২, ৮০ বর্ষ, ১ সংখ্যা, পৃ ৪০)। বন্ধুবান্ধব এবং সেই কিশোরী আমায় বলেছিল দেখেছ, দেশ-এ একজন একটা কবিতা লিখেছে। ঠিক তোমার সঙ্গে নাম মিলে গেছে। আমিই যে ওটা লিখতে পারি কেউ কল্পনাও করেনি, আমিও বলিনি।’ প্রথম কবিতা প্রকাশের আরো কিছু তথ্য জানা যায় সে সময়ে দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এক লেখায়-
‘আমি এককালে দীর্ঘ পঁচিশ বছর দেশ পত্রিকায় কবিতাবিভাগ সম্পাদনা করেছি। একদিন ফাইল খুলে দেখি প্রচুর কবিতা জমে আছে। কিছু কবিতা মনোনীত হত, অমনোনীত কবিতা ডাকটিকিট থাকলে ফেরত পাঠানো হত, নাহলে ফেলে দিতে হত। সেখানে সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজনের কবিতা আমার খুব ভাল লেগে যায়। আমি সেই কবিতাটি মনোনীত কবিতার ফাইলে রেখে দিই। …নতুন কেউ ভাল লিখছে, এ তো খুবই আনন্দের। আমি তখন সুনীলকে একটা চিঠি লিখি, ঠিকানা দেওয়া ছিল তো। সুনীল পরে আমাকে বলে যে, চিঠিটা পেয়ে সে খুব সঙ্কোচ বোধ করেছিল। সুনীল আর সেই চিঠির কোনও উত্তরই দেয়নি।’
(‘কখনও মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৭)।
কবিতাটি যে সুনীল সেই কিশোরীর উদ্দেশেই লিখেছিলেন তা তিনি ওই বয়সে না হোক; পরে অবশ্য অকপটেই স্বীকার করেছেন তার অনেক লেখায়। তাছাড়া সে-সময় প্রেমের ক্ষেত্রে কবিদের পাতে মোটামুটি ভাত জুটতো বলা যায়। আর সাহিত্যপ্রেমী নারীদের কাছে তো কথাই নেই। যাই হোক, হুট করে একদিন দেশ পত্রিকার দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কবিতা, ছাপাও হয়ে গেল। তবে ঘটনা অন্য জায়গায়। সেই কবিতা দেখিয়ে ওই কিশোরী এসে সুনীলকে বলেছিল- ‘দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় একজনের কবিতা বেরিয়েছে। তার নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ দেখ কান্ড! যে-কিশোরী এ-কথাগুলো বলছিল তার চোখের সামনেই যে স্বয়ং কবি দাঁড়ানো তা তাকে কে বোঝায়? তার ওপর মেয়েটি জানতেও পারেনি সেই কবি তার উদ্দেশেই এ-কবিতা লিখেছেন। নিজের কবিতার বিষয়ে অক্লেশে বলে গেছেন সুনীল, কোনো রাখঢাক কখনো কোথাও ছিল না (কেবল নীরা-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর ছাড়া, এ-প্রশ্নে সুনীল বরাবরই বড় রহস্যময় ছিলেন) – ‘আমি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি একটি মেয়েকে উদ্দেশ করে, আমার বয়েস তখন পনেরোর একটু কম (হিসেব অনুযায়ী ১৭)। কিন্তু কথা হচ্ছে এই, হঠাৎ আমি কবিতা লিখতে শুরু করলাম কেন? আমাদের বংশে বা পরিবারে কেউ কখনো লেখক ছিলেন না। সাহিত্যানুকূল আবহাওয়া ছিল না আমাদের বাড়িতে। আমার ধারণা থাকা স্বাভাবিক ছিল যে, কবিতা রচনা অন্য একপ্রকার মনুষ্যজাতির কাজ- কারণ আমার চেনাশুনো আত্মীয়স্বজন, বাবা-কাকা-জ্যাঠামশাইরা আহার-বাসস্থান সংগ্রহেই ব্যতিব্যস্ত। তবে আমার মধ্যে দুর্বলতা হঠাৎ জেগে উঠলো কীভাবে?’ (সূত্র: কবিতার সুখ-দুঃখ, যুগলবন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; প্রথম দে’জ সংস্করণ: শ্রাবণ ১৪০২, আগস্ট ১৯৯৫, পৃ ৯)
এ-প্রসঙ্গে সুনীল তার সাহিত্যের কোন শর্ত নেই গ্রন্থের ‘স্বীকারোক্তি, স্মৃতি, স্বপ্ন’ শিরোনামের লেখায় এভাবেই উত্তর দিয়েছেন নিজে- ‘দুটি কারণে আমি প্রথম কবিতা লিখি। প্রথম যে বালিকার প্রণয়ে লিপ্ত হই সে কবিতা পড়তে ভালবাসত – সে আমাকে যেসব চিঠি লিখত, তার অধিকাংশই কবিতার লাইনে সাজানো। সুতরাং তাকে মুগ্ধ করার জন্য স্বরচিত কবিতায় একবার চিঠি লেখার কথা মাথায় এল। এই সময়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরবর্তী ছুটিতে, আমার বাবা আমাকে দুপুরবেলা বাড়িতে আটকে রাখবার জন্য টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে দিতেন। কয়েকদিন বাদেই আমি নিজেই একটি কবিতা টেনিসনের বলে চালিয়ে দেই। সেটাই সন্ধেবেলা সেই বালিকাটির হাতে দিই, আমার নতুন চিঠি হিসেবে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না ওটা পুরোপুরি আমার লেখা। তখন কবিতাটি কপি করে ডাকে পাঠিয়ে দিই ‘দেশ’ পত্রিকার ঠিকানায়। …‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় আমার কবিতা, নাম ‘একটি চিঠি’। তখন আমি কলকাতার রাস্তাঘাটও ভাল করে চিনি না, ‘দেশ’ পত্রিকার কার্যালয় কোথায় তাও জানি না। আমি শুধু বন্ধুদের ও সেই বালিকাটিকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, ঐ কবিতাটি আমারই লেখা এবং কবিতা লেখার ব্যাপারটা এমন কিছু শক্ত না।’ (‘কালের খেয়া’, সমকাল, ২ নভেম্বর ২০১২, পৃ ৬)।
কবি হওয়ার জন্য সুনীল মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কবিতার আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়নি তাকে কিশোর বয়সে। কবি হওয়ার স্বপ্ন তো দূরে থাক, বরং জীবনে তার স্বপ্ন ছিল জাহাজের খালাসি হয়ে দেশে দেশে ভ্রমণ করার। ছাত্র বয়স থেকেই পায়ের তলে সর্ষে নিয়ে হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন সুনীল। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনো দূরাকাঙ্ক্ষা ছিল না তার। কলেজ-জীবনেও তার সেই জাহাজের খালাসি হওয়ার স্বপ্নটা জিইয়ে ছিল। জাহাজের খালাসির চাকরি অবশ্য তাকে করতে হয়নি। তবে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে দিকশূন্যপুর যাত্রী নীললোহিতকে। নতুন কোথাও বেড়ানোর নেশা আমৃত্যু লালন করে গেছেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬ অক্টোবর ২০১২ সালে প্রকাশিত সম্পাদকীয় পাতায় ‘শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ শিরোনামে যে-স্মরণ অংশটি প্রকাশিত হয় যেখানেও উঠে আসে সুনীলের আমৃত্যু বোহেমিয়ান চরিত্র – ‘ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউইয়র্ক থেকে শান্তিনগর – সুনীলের উৎসাহ সমান।’ সুনীলের আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তি –

‘অনেক লেখকের খুব বাল্যকাল থেকে সাহিত্য রচনার দিকে অনেক ঝোঁক দেখা যায়। আমার ছিল না। আমি বই পড়তে ভালবাসতাম, বই লেখার দায়িত্ব অন্য লোকের। আমার ঝোঁক ছিল নানারকম অ্যাডভেঞ্চারের দিকে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি কোনও না কোনও বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ বাইরে কোথাও চলে যেতাম। এমনও হয়েছে, সিমলা শহরের স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে বসে বিখ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি আমি আর আমার বন্ধু দীপক মজুমদার, পেটে দাউদাউ করে জ্বলছে খিদের আগুন, পকেটে একটাও পয়সা নেই, রাত্তিরে কী খাব তার ঠিক নেই। শুধু সঙ্গে আছে একটি রেলের পাস, তাও অন্যের নামে, সেটার সাহায্যে আমরা যে কোনও জায়গায় চলে যেতে পারি। …অনেকের মতো আমারও ছেলেবেলা থেকেই বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। জাহাজে আলুর খোসা ছাড়াবার চাকরি নিয়েও কোনও একদিন বিদেশে যাব, এ রকম ভেবে রেখেছিলাম এবং আর ফিরব না। সত্যি সত্যি বিদেশে যাবার কিছুদিন পরেই আমি ছটফটিয়ে উঠেছিলাম, আমার মন টেকেনি। তখন আমার কোনও বন্ধন ছিল না। যে কোনও ছুতোনাতায় বাইরের যে কোনও দেশে পাঁচ-সাত বছর কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসেই, কিন্তু বাংলা ভাষা আমার মর্মে এমন গেঁথে গেছে যে এই আবর্জনা-ভরা, শত অসুবিধেয় ভরা কলকাতা ছেড়ে কিছুতেই বেশি দিন দূরে থাকতে পারি না।’
‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’ শিরোনামের লেখায় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে – ‘যখন এ লেখা লিখছি, তখন সুনীল বড় একা হয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা ঘরে, পিস হ্যাভেনে। ডোরবেল বাজিয়ে কেউ আসবে না আজ। সুনীল উঠে গিয়ে দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে বলবে না, আরে, এসো এসো -! … বেড়াতে যেতে বড় ভালবাসত সুনীল। নতুন অচেনা কোনও জায়গায় যাওয়ার কথা শুনলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত চোখ। আজও সুনীল চলল নতুন এক দেশে।’ (‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেশ, ১৬ কার্তিক, ১৪১৯; ২ নভেম্বর ২০১২; ৮০ বর্ষ; ১ সংখ্যা, পৃ ২৩)
আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায়-
‘সুনীল খুব বড় মাপের লেখক, আবার খুব বড় মনের মানুষও বটে। ওর সমসাময়িক যাঁরা সাহিত্যিক, ও চেয়েছে তাদের প্রাপ্যটা যেন তারা পান। ওর মধ্যে কখনও ঈর্ষা, হিংসা দেখিনি। ওর চেয়ে বয়েসে যারা ছোট, তাদের দিকে ও সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, তা নয়, সংসার চালানোরও একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া! যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এসব ব্যাপারে প্রখর নজর ছিল সুনীলের। … এখান থেকেই বলা যায়, সুনীল ভালবাসাকেই তার ধর্ম বলে মেনে এসেছেন। ও বিশ্বাস করত, ভালবাসার ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষের সব অসুখ সারিয়ে তোলা যায়! ধর্মে বিশ্বাস না করুক, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করুক, কিন্তু ভালবাসায় বিশ্বাসী। আসলে, কবিদের কাছাকাছি পৌঁছতে হলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একটা মইয়ের প্রয়োজন হয়, নইলে নাগাল পাব না তো! … সুনীল ঘোষিত নাস্তিক। … সুনীল নাস্তিক হলেও, মানুষের কল্যাণ কামনা করত সব সময়। যদি আমরা ঈশ্বরকে মঙ্গলময় বলে ভাবি, তবে মানুষও তো সেই ঐশ্বরিক দায়িত্বটা নিতে পারে। সুনীল তো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি কখনও, অনেক মানুষের অনেক কুকীর্তি সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। সে দুঃখবাদীও নয়, হতাশাবাদীও নয়, সুনীল অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে তার আশা ভরসাকে সে শেষদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল।’
(‘কখনও মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৮-৩০]
আসা যাক সুনীলের কবিতা প্রসঙ্গে। সুনীলের প্রকাশিত সামগ্রিক কাব্যগ্রন্থগুলো হলো – একা এবং কয়েকজন, আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, বন্দী, জেগে আছো, আমার স্বপ্ন, সত্যবদ্ধ অভিমান (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত যুগলবন্দী গ্রন্থের সুনীলের কবিতাংশ), জাগরণ হেমবর্ণ, দাঁড়াও সুন্দর, মন ভালো নেই, এসেছি দৈব পিকনিকে, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়, স্বর্গ নগরীর চাবি, সোনার মুকুট থেকে।
সুনীলের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তার প্রতিটি কবিতাই আত্মস্বীকারোক্তিমূলক। সুনীলের এমন কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি নিজে উপস্থিত নন। এজন্যই তার কবিতাগুলো উত্তম পুরুষে (আমি, আমার, আমাকে, আমায় প্রভৃতি) লেখা। সুনীলের ভাষায়, ‘আমার প্রতিটি কবিতাই আমার জীবনযাত্রার প্রতিফলন, সেই জন্যেই আমি একাধিক জায়গায় বলেছি, আমার কবিতাগুলো স্বীকারোক্তিমূলক!’ অকপটেই তিনি স্বীকার করেছেন, ‘আমার এমন একটিও কবিতা নেই, যে-কবিতায় আমি ‘আমি’ শব্দটা অন্তত একবারও ব্যবহার করিনি।’ সুনীলের সরল দাবি, ‘আমি তো কবিতাতে আমার জীবনকেই ব্যবহার করেছি। আড়াল করিনি।’ কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক :

আমারও আকাঙ্ক্ষা ছিল সূর্যের দোসর হবো তিমির শিকারে
সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে।
অথচ সময়াহত আপাত বস্ত্তর দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত মনে
বর্তমান-ভীত চক্ষু মাটিতে ঢেকেছি সঙ্গোপনে।

(‘প্রার্থনা’, একা এবং কয়েকজন)

অথবা,

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কি মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি – তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।

(‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি)

অথবা পাঠকপ্রিয় সেই উক্তি,

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?
…এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?

(‘সত্যবদ্ধ অভিমান’, সত্যবদ্ধ অভিমান)

অথবা সুনীলের সেই চির অম্লান কবিতা,

ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে
ফেলেছিলাম
নিঃশব্দ রাত্রির দেশ, তার ওপরে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
অদূরে খাজুরাহো মন্দিরের চূড়া
মিথুন মূর্তিগুলো দেয়াল ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠেছে আকাশে
নীল মখমলে শুয়ে নক্ষত্রদের মধ্যে চলছে শারীরিক প্রেম
আমি যে-কোনো দিকে যেতে পারি
অথচ আমার কোনো দিক নেই!

(‘ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে’, স্বর্গ নগরীর চাবি)

কবিতা লেখার বিষয়ে সুনীলের সুন্দর একটি পঙ্ক্তি আছে। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে কবিতার প্রতি এ-কবির সুন্দর ভালোবাসা।

কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো এই ভাবনা
আরও প্রিয় লাগে

মনে ফুরফুরে হাওয়া, এবার কবিতা, একটি নতুন কবিতা…
তবু আমি কিছুই লিখি না
কলম গড়িয়ে যায়, ঝুপ করে শুয়ে পড়ি, প্রিয় চোখে
দেখি সাদা দেয়ালকে, কবিতার সুখস্বপ্ন
গাঢ় হয়ে আসে, মনে মনে বলি, লিখবো
লিখবো এত ব্যস্ততা কিসের

(‘কবিতার লেখার চেয়ে’, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়)

নিজের সেরা লেখাটি লেখার তৃষ্ণা সব লেখকের মধ্যে থাকে। সুনীলেরও তেমনটি অত্যন্ত তীব্রভাবে। নিজের সেরা লেখাটি উপহার দেওয়ার বুভুক্ষা প্রতিটি কবিমনেই চলতে থাকে আমৃত্যু। এ যেন এক দিকশূন্যপুরের পথে অক্লান্ত যাত্রা।

সেই লেখাটি লিখতে হবে, যে লেখাটি হয়নি
এর মধ্যে চলছে কত রকম লেখালেখি
এর মধ্যে চলছে হাজার হাজার কাটাকাটি
এর মধ্যে ব্যস্ততা, এর মধ্যে হুড়োহুড়ি
এর মধ্যে শুধু কথা রাখা আর কথা ভাঙা
শুধু অন্যের কাছে, শুধু ভদ্রতার কাছে, শুধু দীনতার কাছে
কত জায়গায় ফিরে আসবো বলে আর ফেরা হয়নি

(‘সেই লেখাটা’, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়)