নিজস্ব প্রতিবেদক
৭৭ ভাগ মজুরি বাড়ার পর পোশাকের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ, ক্রেতাদের কাছ থেকে তা আদায় করে কারখানার মালিক ও শ্রমিক সবাইকে নিয়ে টিকে থাকাটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। বর্ধিত বেতনের ‘ঠ্যালা’ সামলে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়ান্সের আরোপিত চাওয়াগুলোতে কমপ্লাই করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
‘৭৭% বেতন বাড়ার পর আমরা খুব একটা ভালো নেই। বেশির ভাগ কারখানাই চলছে ক্ষতি সামলে। ক্ষতির মাত্রা সইতে না পেরে ইতিমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বায়াররা পোশাকের দাম এক পয়সাও বাড়ায়নি এবং প্রোডাক্টিভিটি রয়ে গেছে আগের জায়গায়,’ জানালেন পলমল গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের প্ল্যানিং ও কুঅর্ডিনেশন জেনারেল ম্যানেজার বিপ্লব কুমার মহাজন।
তিনি বলেন, “শুধু যে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে, তা নয়। ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক অ্যাকর্ড ও অ্যালায়ান্সের সঙ্গে কমপ্লাই করার জন্য কারখানাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে মালিকদের গলদগর্ম অবস্থা। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হলো, পোশাকের মূল্য নির্ধারণের সময় বায়াররা যথারীতি মাত্রাতিরিক্ত প্রফেসনাল। গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, কয়েক’শ কারখানা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ একটাই, বাড়তি মজুরি।”
বেতন বাড়ার বিষয়টি একটা চাপিয়ে দেয়া ব্যাপার বলে মনে করেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। বর্ধিত খরচের বিষয়টা ক্রেতাদেরও আমলে নিতে হবে, বলে মনে করেন বিপ্লব কুমার মহাজন। তিনি বলেন, “ক্রেতাদের এগিয়ে আসতে হবে ভালো দাম নিয়ে। নাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।”
জেএনআর অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সিইও রেজাউল হক বলেন, “ক্রেতারা যদি পোশাকের মূল্য শুধু ১০ পেন্স বাড়ায় তাহলেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতকে ঢেলে সাজানো সম্ভব। নিরাপত্তাজনিত সব ধরনের সমস্যা দূর করা সম্ভব। ক্রেতারা তাদের দেশে আমাদের পোশাক ক্রয়মূল্য থেকেও চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি করে, কিন্তু আমাদের বিক্রয় মূল্য বাড়াতে চায় না।”
তিনি বলেন, “বড়-বড় দু’টি দুর্ঘটনার পর কারখানা কমপ্লায়ান্স ও পোশাকের মূল্য বাড়াবার প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশের অনেক ভালো কমপ্লায়ান্ট কারখানা ক্রেতাদের কাছে ২০ ভাগ মূল্য বৃদ্ধির কথা তোলে এবং মূল্য বাড়াতে ক্রেতাদের অনুরোধ করে। এতে ক্রেতারা খুব অবাক হয় ও উত্তরে বলে, ‘আমরা ভেবেছিলাম তোমরা ৫ ভাগ বাড়াতে বলবে। কেউ কেউ আবার আরো দাম কমাতে বলেছে।” এ পর্যন্ত কোনো ক্রেতাই এক সেন্টও মূল্য বাড়াতে রাজি হয়নি বলেও জানান তিনি।
একটি কথা অবশ্য থেকেই যায়। তা হচ্ছে, একটা সময় আসবে, হয়তো খুব শিগগির আসবে, যখন বাংলাদেশ আর কম দামে মাল দিতে পারবে না, জানালেন বিপ্লব কুমার মহাজন। তিনি বলেন, “যে সব কারখানা শেষতক টিকে থাকবে তারা লাভজনক একটা প্রাইস ধরে গো ধরে বসে থাকবে; তখন ক্রেতাদের তাদের কাছে আসতেই হবে। বাংলাদেশ এখনো কম দামে পোশাক সাপ্লাই দেয় ক্রেতাদেরকে। অন্য দেশে গিয়ে এখনো সুবিধা করতে পারবে না। অতএব, ক্রেতাদের চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, বর্ধিত খরচ আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধাক্কা সামলে ক’টা কারখানা টিকে থাকে, সেটাই দেখার বিষয়। অনেকেই যে পাত্তারি গুটিয়ে ফেলবে, সেটা সুনিশ্চিত। ফলস্বরূপ, বাজারে শ্রমিকের আধিক্য দেখা দেবে। একটা ভারসাম্যহীনতা এড়ানো অসম্ভব আগামী দিনগুলোতে।”
তবে কি বাংলাদেশ থেকে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিপ্লব কুমার মহাজন বলেন, “এই খাত এত তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও যাবে না। মিয়ানমার এগুচ্ছে বটে, তবে আমাদের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় ভাগ বসাতে ওদেরকে কম করে হলেও ১০টা বছর তো পাড়ি দিতে হবে। ব্যাপারটা এরকম, আপনার অর্থ আছে, কারখানা খুলে বসলেন, মেশিন কিনলেন, কিন্তু পর্যাপ্ত অপারেটর আছে কি? নেই। মেশিনে মেকানিক আছে? নেই। এই শিল্প চালাতে অনেকগুলো সাপোর্টিং জিনিস লাগে যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের আশেপাশে গড়ে উঠে।”
বিপ্লব কুমার মহাজন জানালেন, ক্রেতারা চীনে খুব উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিল। পারেনি যুতসই ব্যবসা করতে। অনেক ক্রেতার স্টোর আছে চীনে। এখন তারাই তাদের সেসব স্টোরের জন্য উল্টো বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিচ্ছে। তিনি বলেন, “সুতরাং, এত তাড়াতাড়ি ক্রেতারা এই দেশ থেকে সোর্সিং কমাতে কিংবা থামাতে পারবে না।”
এদিকে যেসব কারখানা কম্পলায়ান্ট তাদের জন্য ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তাদের জন্য ক্রেতাদের সুযোগ সুবিধাও বাড়ছে। আর যারা ছোট কারখানা তারা নিজেদের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। রেজাউল হক বলেন, “সব সময় কিছু দুর্বল কারখানা থাকবে যারা ধুঁকতে-ধুঁকতে এগুবে। বেতন বাড়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এমনটি আমার চোখে পড়েনি।”
বিজিএমইএ’ও তাই বলছে। বিজিএমইএ’র গবেষনা দফতর বলছে বেতন বাড়ার কারণে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়েছে কমপ্লাই না করার কারণে।
তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নানা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন বর্ধিত মজুরির ভার সইতে না পেরে অনেক কারখানা আগে থেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করেছিল। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে কমপ্লায়েন্স ইস্যু। এ ইস্যুতে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। ফলে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে বলে খবরে বেরিয়েছে। আরো পাঁচ লাখ বেকার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেকার হওয়া এ শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। শ্রম আইন অনুযায়ী কারখানার মালিকদের এ ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা থাকলেও অনেক ছোট উদ্যোক্তা তা পারবেন না বলে বিজিএমইএ মনে করছে।
বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “যারা কর্মচ্যুত হচ্ছেন তাদের দ্রুত কর্মসংস্থানের জন্য বিজিএমইএ ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বন্ধ কারখানাগুলোর সংস্কার ও স্থানান্তরে আর্থিক সহায়তা, ব্যাংক ঋণের সুবিধা, নতুন কারখানা করতে চাইলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হবে।” তিনি বলেন, “কারখানা হয়তো খুব বেশি বন্ধ হবে না। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে ক্রেতারা এ ইস্যুতে রফতানি আদেশ বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে মালিকরা আর্থিক চাপের মধ্যে পড়ছেন।”
কর্মচ্যুত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের বেতন বড় উদ্যোক্তারা হয়তো দিতে পারছেন। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তাদের রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে তারা কিভাবে তা দেবেন?” এ ক্ষেত্রে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।