ঢাকারবিবার , ২ নভেম্বর ২০১৪
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও অন্যান্য
  5. খেলাধুলা
  6. গল্প ও কবিতা
  7. জাতীয়
  8. তথ্যপ্রযুক্তি
  9. দেশজুড়ে
  10. ধর্ম ও জীবন
  11. প্রবাস
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. বিশেষ প্রতিবেদন
  15. মুক্তমত
আজকের সর্বশেষ সবখবর

‘জল্লাদের’ ফাঁসি দ্রুত কার্যকর চান অন্যতম সাক্ষীরা

দৈনিক পাঞ্জেরী
নভেম্বর ২, ২০১৪ ১:২৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

Mir-kasemচট্টগ্রাম প্রতিনিধি : একাত্তরে চট্টগ্রামে আল বদর বাহিনীর কমান্ডার ও বুদ্ধিজীবি হত্যার তালিকা প্রণয়নকারী জল্লাদ মীর কাসেম আলীর রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরার দাবি জানিয়েছেন নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা ও মামলার অন্যতম সাক্ষী সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান ও নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। সৈয়দ এমরানের সাক্ষীতেই মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড হয়।
রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ চট্টগ্রামে বদর বাহিনীর প্রধান মীর কাসেম আলীকে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন হত্যাসহ গুমের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বিএলএফ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নগরীর চান্দগাঁও নুরুজ্জামান নাজির বাড়ির বাসিন্দা সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান হলেন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ১ নম্বর সাক্ষী।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সৈয়দ এমরান বলেন, ‘আমিসহ চট্টগ্রামের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মীর কাসেম নগরীর ডালিম হোটেলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করেছে। এখন মনে হচ্ছে এতদিন বয়ে বেড়ানো আমাদের সেই নির্যাতনের ক্ষত কিছুটা মুছে গেছে। দীর্ঘ আন্দোলন ও প্রতীক্ষার পর একাত্তরের এই জল্লাদের ফাঁসি হয়েছে, এখন রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।’
একাত্তরে সেই সময়ের নির্যাতনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ এমরান বলেন, ‘চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের টর্চার সেল ডালিম হোটেলে জল্লাদ মীর কাসেমের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছি ৩০ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত।’
‘মীর কাসেম আলী শুধু আন্দরকিল্লা’র ডালিম হোটেলের টর্চার সেলের মূল হোতা নয়, কুখ্যাত মীর কাসেম বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ণকারীর হোতাও। নিজের আসল নাম গোপন করে মীর কাসেম ছদ্মনাম ডা. খান কিংবা ডা. হাং নামে পরিচিত ছিল বদর বাহিনীর সদস্যদের কাছে।’
তিনি বলেন, ‘মীর কাসেমকে আমি কলেজিয়েট স্কুল থেকে চিনি। সে ডা. খান নামে টর্চার সেলে এলেও আমরা তার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেছি। পরে বিশেষ কৌশলে আমাদের চোখ বাঁধা থাকলেও তাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। সে আমাকে ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে অবস্থান জানার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল। তার ধারণা ছিল, আমাকে হত্যা না করে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সে জানতে পারবে।’
সেই দিনের নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘২৯ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত চান্দগাঁও এলাকায় আল বদর বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। যুদ্ধে আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তাদেরকে আমরা পরাস্ত করি। এরপর আমরা যার যার নিরাপদ আশ্রয়স্থলে চলে যাই। আমি আমার বাড়িতে একটা ঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলাম। আমি বাড়িতে অবস্থানকালে ভোর রাত ৪টা-সাড়ে ৪টার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী, পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকাররা আমার বাড়ি ঘেরাও করে। তারা আমাকেসহ আমার বড় ভাই সৈয়দ মো. ওসমান, জেঠাতো ভাই সৈয়দ মো. জামাল উদ্দিন, সৈয়দ কামাল উদ্দিন, সৈয়দ সরোয়ার উদ্দিন, চাচাতো ভাই সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া ও সৈয়দ গোলাম রহমানকে আটক করে।’
এমরান উদ্দিন বলেন, ‘আটকের পর রাইফেল দিয়ে আমাকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। তারপর আমাদের ৫ ভাইকে এক রশিতে বেঁধে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১ কি. মি. দূরে এনএমসি স্কুলের সামনে নিয়ে যায় যেখানে সাধারণ পরিবহনের দুটি ট্রাক দাঁড়ানো ছিল। আমাদেরকে ওই স্কুলের সামনে নেয়ার পর আমাদের সাবানঘাটা বেজ থেকে মাওলানা নূরুল ইসলাম, নূরুল কুদ্দুস, নূরুল হাশেম, নাসিরসহ আরো কয়েকজনকে যাদের নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই তাদেরকেও সেখানে নিয়ে আসে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারপর আমাদের বাকি সবাইকে চোখ বেঁধে দুটি ট্রাকে উঠিয়ে আন্দরকিল্লাস্থ ডালিম হোটেল আল-বদর টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাম্পটির নেতৃত্বে ছিল মীর কাসেম আলী। এরপর আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে লাঠি, ইলেকট্রিক ওয়্যার এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকালীন সময়ে আমি বারবার মূর্ছা গেলে পানি ছিটিয়ে আমার চেতনা ফেরানো হতো। এক পর্যায়ে আমাকে চোখ খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।’
সৈয়দ এমরান বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ করে মীর কাসেম আলী। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমার কাছে কি কি অস্ত্র আছে, কি কি ট্রেনিং নিয়েছি, কতজন যোদ্ধা আছে ইত্যাদি। নির্যাতন শেষে আমাকে রক্তাক্ত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ধাক্কা দিয়ে অন্য একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়া হয়। আমি সেখানে আরো অনেক বন্দীর আওয়াজ শুনতে পাই। তাদের মধ্যে কেউ একজন আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং তার পরনের কাপড় দিয়ে আমার শরীরের ক্ষতস্থান থেকে নির্গত রক্ত মুছে দেয়।’
যে অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসি হয়েছে সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিদ উদ্দিন হত্যার বর্ণনা দিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ এমরান বলেন, ‘ডালিম হোটেলে বন্দি অবস্থায় সেখানে বন্দিরত অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানতে পারি ১৯৭১ সালে ২৮ নভেম্বর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন করে আমরা যে রুমে বন্দী ছিলাম সেখানে এনে মেরে ফেলা হয়। তার নাম ছিল জসিম উদ্দিন। সে সন্দ্বীপের একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। স্বপন নামে একজন আল বদর ক্যাম্পের কর্মচারীর কাছ থেকে আমার সঙ্গে আটক অন্য বন্দিরা জসিমের নামটি জানতে পারে। এর মধ্যে সানাউল্লাহ চৌধুরী জসিমকে চিনতেন। স্বপনের কাছ থেকে তারা আরো জানতে পারেন যে, ওই ডালিম হোটেলের অন্য একটি কক্ষে আরো ৩/৪ জন বন্দীকে হত্যা করে সকলের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।’
পরে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা তাদের ডালিম হোটেল থেকে মুক্ত করে আনেন বলে জানান তিনি।
একাত্তরে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর প্রধান জল্লাদ মীর কাসেমের হাতে নির্যাতিত আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি মামলার ১৪ নম্বর সাক্ষী। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়নকারী মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানান এ মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, ‘একাত্তরে মীর কাসেম আলী ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি। আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের কমান্ডার হয়ে মুক্তিকামী বাঙালি জনতাকে পৈশাচিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে মীর কাসেম আলী হয়ে উঠেছিলেন নির্মমতার প্রতীক। তিনি ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশা প্রণয়নকারী। তার নির্মমতার চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকেসহ আরো অনেক নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধাকে। তার ফাঁসির দাবিতে বুদ্ধিজীবীদের আত্মা, শহীদদের আত্মা আকাশে, বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের এই আদেশের মাধ্যমে তাদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।’
নাসিরুদ্দিন চৌধুরী তার ওপর বদর বাহিনীর চালানোর নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী রোডে একটি বাড়িকে ঘাঁটি বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা অবস্থান করি। এর কয়েকশ গজ দূরেই পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে আল বদর বাহিনী মহামায়া ভবন দখল করে গড়ে তোলে টর্চার ক্যাম্প তথা জল্লাদ মীর কাসেমের আস্তানা।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ওই ঘাঁটি থেকে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা এসে ধরে হাত বেঁধে টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে পা উপরে তুলে মাথা নিচের দিকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল। যেই কক্ষে পায়খানা, প্রস্রাব করতে বাধ্য করা হতো আবার সেই কক্ষেই খাবার খেতে দেয়া হতো।’
নাসিরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘ওই টর্চার ক্যাম্পে মীর কাসেম আলীর নির্দেশে বদর বাহিনীর সদস্যরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদায়ের জন্য নির্মমভাবে নির্যাতন করতো। তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ।’
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই বদরবাহিনীর লোকজন ছিল রাজাকার বাহিনীর চেয়েও ভয়ঙ্কর ও খারাপ। রাজাকার বাহিনীতে কেউ অভাবে কিংবা লোভে পড়ে যোগ দিলেও এরা প্রত্যেকই শিক্ষিত ও সচেতন ছিল। তারা পরিকল্পিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানিদেও সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। চট্টগ্রামে বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে মীর কাসেমের কৃতকর্মের জন্য ফাঁসিই তার প্রাপ্য ছিল। এখন যে রায় হয়েছে সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।’