নিজস্ব প্রতিবেদক : যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছে না সিগারেট কোম্পানিগুলো। উচ্চমাত্রার কর ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর কোম্পানিগুলোকে গুণতে হচ্ছে মোটা অংকের লোকসান। তাই তামাকজাত দ্রব্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের লোকসান পুষিয়ে নিতে এবার টার্গেট করেছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। আর দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে উদীয়মান তরুণদের।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকাশ্যে সিগারেটের প্রচার প্রচারণায় আইনগত বাধা থাকায় কোম্পানিগুলো কৌশলে তাদের প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু বাংলাদেশের তরুণ সমাজ একটু সংস্কৃতিপ্রেমী এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চায় তারা। গভীর রাতে তামাক কোম্পানির আয়োজিত কনসার্টে তরুণদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এসব কনসার্টের আয়োজন করা হয় গুলশান, বনানীসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকার নামি-দামি হোটেল ও রেস্টুরেন্টে। যেখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করার কোনো অনুমতি থাকে না।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, দিনের বেলায় রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমণ্ডি এলাকায় যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার আসে-পাশে স্মার্টফোন অথবা ট্যাব হাতে সুদর্শন ছেলেদের ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। তারা সুযোগ বুঝে সুকৌশলে আড্ডা দিতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করে কনসার্টে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে।
আইনি জটিলতার কারণে তারা প্রকাশ্যে দাওয়াতপত্র বিলি করতে না পারর কারণেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার। সংগৃহীত মোবাইল নম্বরে পরে এসএমএসের মধ্যমে কনাসার্টের তারিখ ও স্থান জানিয়ে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৭ নভেম্বর রাজধানীর গুলশানের অল কমিউনিউটি ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় ‘লাইভ-টু রক সিটি’ কনসার্ট। এই কনসার্টের নামে রাজধানীর একাধিক হোটেলে চালানো হয় ফিলিপ মরিস কোম্পানির সিগারেট মার্লবোরোর প্রচারণা।
ওই কনসার্টকে কেন্দ্র করে পুরো হলরুমের চারিদিক সিগারেটের লোগো দিয়ে সাজানো হয়। বসানো হয় সিগারেট বিক্রির বুথ। যেখানে সুন্দরী তরুণীদের বিক্রয়কর্মী হিসেবে রাখা হয়। যারা বিক্রি করছে মালবোরো সিগারেট। প্রতি প্যাকেট সিগারেটের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে ফিলিপ মরিসে লোগো সম্বলিত লাল রং সদৃশ লাইটার। গানের তালে তালে হলরুমে চলে তরুণ-তরুণীদের ধূমপান। যা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ এর পরিপন্থি।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবারও রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণও জানানো হয়। তবে কনসার্টে সিগারেটের প্রচারণা চালানো হবে এমন তথ্য জেনে হল কর্তৃপক্ষ বুকিং বাতিল করে দেয়।
এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) সুপারিনটেনডেন্ট মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘শুক্রবার একটি কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। আমরা জানতে পেরেছি ওই কনসার্টের নামে সিগারেটের প্রচারণা চালানো হবে। তাই তাদের কনসার্ট বাতিল করেছি।’
বাংলাদেশে প্রায় দেড়শর মতো তামাকজাত কোম্পানি থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে সিগারেটের প্রচারণা চালাচ্ছে। এগুলো হলো- ব্রিটিশ আমিরিকান কোম্পানি টোবাকো কোম্পানি (বিএটিএ), ঢাকা টোবাকো, আবুল খয়ের টোবাকো কোম্পানি। এর মধ্যে ঢাকা টোবাকো আজিক গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামাক জাত কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেশনের (পিএমআই) মার্লবোরো সিগারেটটি বাজারজাত করছে এই কোম্পানিটি।
এদিকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ এ বলা হয়েছে, ‘প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।’
আরো বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা তা ব্যবহারে উৎসাতি করার উদ্দেশ্যে কোনো দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান বা কোনো অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার (স্পনসার) বহন করতে পারবে না।’
আইনে আরো বলা আছে, ‘কোনো প্রেক্ষাগৃহে, মঞ্চ অনুষ্ঠান, প্রিন্ট ও ইলেস্ট্রনিক মিডিয়ায় বা ওয়েবপেজে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যসম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না।’
শাস্তির ব্যাপারে বিধানে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি এ আইন লঙ্ঘন করলে অনুর্ধ্ব তিনমাস কারাদণ্ড বা অনাধিক এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।’
গোপনে প্রচারণা চালানো প্রসঙ্গে প্রত্যাশা মাদকবিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমদ বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন পন্থায় তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ফিলিপ মরিস কোম্পানির মালবোরো ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় গোপনে কনসার্টের আয়োজন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করছি। সরকার যেন ওইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।’
তামাকবিরোধী জোটের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘ঢাকার মতো একটা জায়গায় বসে তামাক কোম্পানিগুলো বার বার আইন লঙ্ঘন করছে, তারপরও তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সরকার কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে আইন লঙ্ঘন কম হবে বলে মনে করেন এ সমাজকর্মী।
তিনি বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বড় দুর্বলতা হলো কোনো ব্যক্তি সরাসরি মামলা করতে পারে না। মামলা করার ক্ষমতা এককভাবে সরকারে কাছে রয়েছে। আমরা মনে করি, যেহেতু তারা (সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা) ক্ষমতা সংরক্ষিত করে রেখেছেন তাই তাদের উচিৎ এসব বিষয়ে মামলা করা। আমরা আশা করি, তামাক কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’
এ বিষয়ে আকিজ গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে হলে কথা বলা সম্ভব হয়নি।