হাসান রেজা : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য সেক্টরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মৎস্য সম্পদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণসহ ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর ধারাবাহিকতায় তৃণমূল পর্যায়ে মৎস্য চাষ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে মৎস্য অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পটি। কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে মৎস্য উৎপাদন ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২শ’ ৪২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মার্চ-২০১৫ থেকে জুন-২০২০ মেয়াদের এ প্রকল্পটি দেশের ৬১টি জেলার ৩৫০টি উপজেলার ৩ হাজার ইউনিয়নে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

রাজশাহীর পুঠিয়ায় মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ ফলাফল প্রদর্শনী খামার
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত ইউনিয়নগুলোর স্থানীয় মৎস্য চাষিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে উন্নত মৎস্যচাষ প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বাড়ানো বহুলাংশে সম্ভব হবে। পাশাপাশি মৎস্যচাষ ও বিভিন্ন মৎস্য সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে মৎস্য বিষয়ক সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে স্থানীয় জলজ সম্পদের সুষম ব্যবহারেও ভূমিকা রাখছে প্রকল্পটি। এছাড়া মৎস্যচাষ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি চাষিদের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকার করা প্রয়োজনে উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সমস্যা নিরসন করা হচ্ছে। এছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদ, লিফ এবং স্থানীয় মৎস্যচাষিদের সমন্বয়ে মাঠপর্যায়ে স্থায়িত্বশীল সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। মোটকথা সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র, মৎস্যনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প সূত্র।

মটরসাইকেল বিতরণ করছেন প্রকল্প পরিচালক ড. জোয়াদ্দার মো. আনোয়ারুল হক
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৎস্য অধিদপ্তর বিগত কয়েক দশক ধরে যুগোপযোগী ও লাগসই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করে আসছে। তবে ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্প’র মাধ্যমে সারাদেশের ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণের ধারণা একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ৪৮২টি উপজেলার পল্লী অঞ্চলে প্রায় ২৫ লাখ পুকুর যার আয়তন প্রায় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩শ’ ৯ হেক্টর এবং প্রতি উপজেলায় গড়ে ৫ হাজার ২শ’ (প্রতি ইউনিয়নে গড়ে ৪শ’-৫শ’) পুকুর, ৫ হাজার ৪শ’ ৮৮ হেক্টর বাওড় এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ২শ’ ৭৪ হেক্টর চিংড়ি খামার আছে। গত ১০ বছরে অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে; যা প্রধানত পুকুরে মাছ চাষ সম্প্রসারণের ফলেই সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে হেক্টর প্রতি মাছের বাৎসরিক গড় উৎপাদন প্রায় ৩.৫ মে. টন, যা উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনার তুলনায় কম। লাগসই উন্নত প্রযুক্তি অনুসরণ করে মাছ চাষ করা হলে বর্তমানের দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তি মৎস্য চাষিদের নিকট হস্তান্তর করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী এবং ইউনিয়নভিত্তিক স্থায়ী সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনা অনস্বীকার্য। এ বাস্তবতার আলোকে গ্রাম পর্যায়ে প্রদর্শনী খামার স্থাপন এবং চাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মৎস্য চাষের উন্নত প্রযুক্তি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করেছে প্রকল্পটি।

লিফদের মধ্যে বাইসাইকেল বিতরণ
প্রকল্প মেয়াদে মূল কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে, ৯টি মৎস্য চাষ প্রযুক্তি প্যাকেজের আওতায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মৎস্য চাষির পুকুরে ৩ হাজার করে কার্প নার্সারি, কার্প মিশ্রচাষ ও মনোসেক্স তেলাপিয়া প্রদর্শনী, ১ হাজার ৫শ’ পাংগাস চাষ প্রদর্শনী, ১ হাজার গলদা/বাগদা কার্প মিশ্রচাষ, ১ হাজার ধানক্ষেতে মাছচাষ, ৫ শ’ কৈ,শিং, মাগুর চাষ, সিবিজি’র আওতায় ৮শ’ ৫০টি কার্প মিশ্রচাষ, ৫০টি পেনে মাছ চাষ এবং ১শ’টি খাঁচায় মাছ চাষ প্রদর্শনী স্থাপন। এই প্রদর্শনী স্থাপনে মৎস্য চাষিকে ১৫ হাজার টাকার সমপরিমাণ মাছ চাষের উপকরণ অনুদান হিসেবে বিতরণ এবং সিবিজি প্রদর্শনী স্থাপনে সংশ্লিষ্ট গ্রুপকে ২ লাখ টাকার উপকরণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রকল্পের এই কার্যক্রমে প্রায় ১ লাখ সুফলভোগী সরাসরি উপকৃত হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণের জন্য মাসিক ২ হাজার টাকার সম্মানি ভাতায় ৩ হাজার জন লিফ (মাঠকর্মী) নিয়োগ, প্রতি ৬টি ইউনিয়নের জন্য ১ জন করে, ৫শ’ জন ক্ষেত্র সহকারি অস্থায়ীভাবে নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে। এছাড়া ৯৮ হাজার জন চাষি, ৩ হাজার জন লিফ ২ বার করে, অধিদপ্তর ও প্রকল্পের ১ হাজার ৫শ’ ৫০ জনসহ মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৫শ’ ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১ হাজার ৮শ’ জনের অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর এবং ১ হাজার ৪শ’ মাঠ দিবস পালন করা হবে প্রকল্প মেয়াদে। ৩ হাজার ইউনিয়ন পরিষদে ইউনিয়ন মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও মৎস্য চাষ পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপনসহ এ বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ পরিচালনায় ইউনিয়ন পরিষদকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে মাছ চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৮টি মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভবনের উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও সংস্কার করা হবে প্রকল্পের মেয়াদে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ২টি ও ৭টি বিভাগীয় পর্যায় ৩টি করে ২১টি ওয়ার্কশপ ও সেমিনার এবং প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরীর জন্য ৩টি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হবে।
কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচাল ড. জোয়াদ্দার মো. আনোয়ারুল হক দৈনিক পাঞ্জেরীকে বলেন, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১৪ হাজার প্রদর্শনীর মধ্যে ২ হাজার ২৪০টি প্রদর্শনী সম্পন্ন হয়েছে; মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৫শ’ ৫০ জন মৎস্যচাষি, লিফ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারি প্রশিক্ষণের মধ্যে ১৯ হাজার ১শ’ ৮৩ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, ৩ হাজার জন লিফ-এর মধ্যে ২ হাজার ৯শ’ ৪৩ জন লিফ নিয়োগ করা হয়েছে, ৫শ’ জন ক্ষেত্র সহকারির মধ্যে সবাইকে নিয়োগ করা হয়েছে; ৮টি মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডরমিটরি নির্মাণ ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩টির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রকল্পের সামগ্রিক কার্যক্রম অত্যন্ত সন্তোষজনক গতিতে এগিয়ে চলছে বলেও জানান তিনি।