ঢাকাবুধবার , ১৯ নভেম্বর ২০১৪
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও অন্যান্য
  5. খেলাধুলা
  6. গল্প ও কবিতা
  7. জাতীয়
  8. তথ্যপ্রযুক্তি
  9. দেশজুড়ে
  10. ধর্ম ও জীবন
  11. প্রবাস
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. বিশেষ প্রতিবেদন
  15. মুক্তমত
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বিশ্ব টয়লেট দিবস
কাগজের ফর্দেই সিটির শৌচাগার

দৈনিক পাঞ্জেরী
নভেম্বর ১৯, ২০১৪ ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

Toiletনিজস্ব প্রতিবেদক : উন্নয়নের বাহারি বুলি বা অগ্রগতির নানা ফিরিস্তির বিপরীত বাস্তবতায় এখনো বিশ্বের প্রায় আড়াই বিলিয়ন মানুষের শৌচাগার ব্যবহার করার সামর্থ্য নেই। এ কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছরই মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
তাই এবিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০১ সালে প্রতিবছরের ১৯ নভেম্বরকে বিশ্ব টয়লেট দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ। বিশ্ব টয়টেল দিবসের এবার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সমতা ও মর্যাদা’। নারী ও কন্যাশিশুদের যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও সহিংসতা কমাতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং উন্মুক্ত জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ না করতে অনুপ্রাণিত করাই এ বছরের উদ্দেশ্য।
দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। কিন্তু দিবসটি বারবার ফিরে এলেও দেশের খোদ রাজধানী ঢাকার পাবলিক টয়েলেটগুলোরও কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এখানে বসবাসকারী দেড়কোটি রাজধানীবাসীর জন্য পাবলিক টয়লেট রয়েছে মাত্র ৬৯টি। সে হিসেবে প্রতি সোয়া দুই লাখ মানুষের জন্য রয়েছে একটি করে শৌচাগার!
সংখ্যার দিক থেকেই শুধু অপ্রতুল নয়, এসব শৌচাগারের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখলে গা গুলিয়ে উঠবে। তাও আবার টাকা দিয়েই ব্যবহার করতে হয় এসব শৌচাগার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন এসব শৌচাগারগুলো নিতান্ত বিপদে পড়ে মানুষ ব্যবহার করেন। তাও শুধু পুরুষ পথচারীরা এগুলো ব্যবহার করতে পারেন, নারীদের ব্যবহার উপযোগী কোনো পাবলিক টয়লেটে পুরো রাজধানীতেই নেই।
রাজধানীর গণশৌচাগারের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করলেও এর নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, বেশি টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগ অস্বীকার করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব শৌচাগার যথেষ্ট ভালোভাবে চলছে, পরিবেশও অনেক উন্নত।
২০১১ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ বসবাস করেন। বর্তমানে এর সংখ্যা দেড়কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ কাজের তাগিদে বাড়ি থেকে বের হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের প্রয়োজনে অস্থায়ীভাবে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানীতে আসেন।
এখানে বসবাসরত মানুষের জন্য নিজস্ব পরিসরে শৌচাগারের মোটামুটি ব্যবস্থা থাকলেও ভাসমান মানুষের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে কাজের সন্ধান কিংবা জীবিকা নির্বাহে অধিকাংশ সময় নগরবাসীকে ঘরের বাইরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হয়। এসব মানুষের স্বাভাবিকভাবেই শৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় শৌচাগার না থাকায় অনেক পথচারী যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন রোগজীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে।
মলমূত্রের জীবাণুর কারণে দূষণের ফলে খুব সহজেই মানুষ পানিবাহিত রোগ, জণ্ডিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। যার প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মোট ৬৯টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে, এর মধ্যে ৪৭টি দক্ষিণের, ২৩টি উত্তরের। যার মধ্যে মাত্র ৫টি মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী। ২টি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ১০টি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। ১০টিতে কোনো সেবা নেই। এর মধ্যে ৭৫ ভাগ শৌচাগারে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। ৫০ ভাগ টয়লেটে নিয়মিত পানি থাকে না এবং ৭০ ভাগে প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের জরিপে আরো দেখা গেছে, শৌচাগারগুলোর মধ্যে ৪৭টি চালু রয়েছে। আর মাত্র দুটিতে নারী কর্মী আছেন। বাকিগুলোতে নারী কর্মী না থাকায় নারীরা সেখানে যান না।
অন্যদিকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্নস্থানে অবস্থিত চারহাজার ৭০০ বস্তির কোনটিতেই নেয় স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা। তবে সিটি করপোরেশনের দাবি এসব বস্তির প্রতিটিতেই একটি করে ভ্রাম্যমাণ গণ-শৌচাগার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এর কোথাও কোনা পাবলিক টয়লেট নেই।
করপোরেশনের বেশ কয়েকটি স্থানে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আরবান প্রকল্প ও ওয়াটার এইডের তত্বাবধানে বেশ কিছু ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার দেখা গেলেও এগুলো ব্যবহারের জন্য জনসাধারণকে ৫টাকা করে দিতে হচ্ছে। এ কারণেই ফুটপাতে বসবাসকারীসহ সাধারণ মানুষ এগুলো ব্যবহার না করে যত্রতত্রই মলমূত্র ত্যাগ করেন।
জানা গেছে, ৫টি আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে ডিএসসিসির গণশৌচাগারগুলো চলছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, বেদখলে রয়েছে কয়েকটি। আবার অনেকগুলো ইজারা না দিয়ে সিটি করপোরেশন নিজেই তদারকি করছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশের ৫৬ ভাগ জনসাধারণ স্যানিটেশন সুবিধা ভোগ করছে। এর মধ্যে ৫৭ ভাগ নগর এলাকায় এবং ৫৫ ভাগ গ্রামাঞ্চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের ২০১২ সালের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮১ ভাগ স্যানিটেশন কাভারেজের নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য স্যানিটেশনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হলেও এ বিষয়ে নজর নেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের।
ডিএসসিসির সম্পত্তি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নিয়মিত পরিষ্কার করা, ব্লিচিং পাউডার ছিটানো, হাত ধোয়ার সাবান সরবরাহসহ আরও কিছু শর্তে বার্ষিক চুক্তিতে শৌচাগারগুলো ইজারা দেয়া হয়। চুক্তিতে নারীদের ব্যবহারোপযোগী রাখার কথাও বলা আছে। কিন্তু ইজারাদারের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব কার, সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি এ কর্মকর্তার কাছ থেকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ শৌচাগারগুলোর পরিবেশ নাজুক। এগুলোর কোনেটিতেই হাত ধোয়ার সাবান নেই। পরিবেশ নোংরা তার সাথে দেয়ালে অশ্লীল অশ্রাব্য লেখার ছড়াছড়ি। ভেতরের দেয়ালে নানা রকম অশ্লীল বাক্য, ছবি আঁকা ও সঙ্গে মোবাইল নম্বর জুড়ে দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, গণশৌচাগারগুলোতে ব্যবহারকারীদের থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী পায়খানার জন্য ৩ টাকা এবং প্রস্রাবের জন্য ২টাকা করে আদায় করার কথা। কিন্তু উভয়টির জন্য আদায় করা হচ্ছে ৫ টাকা করে।
ওসমানী উদ্যানের শৌচাগারে আসা মনসুর আহমেদ বলেন, ‘উপায় নেই, কই যাবো? রাস্তায় তো করতে পারি না তাই বাধ্য হয়েই এখানে এসেছি। দুর্গন্ধে বসা যায় না, সাবান, তোয়ালে কিছুই নেই। নারী পুরুষ সবাই একই টয়লেট ব্যবহার করতে হয়।’
ওই শৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক তাজুল ইসলাম জানান, এই শৌচাগারটি সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। গত বছর এটি ইজারা দেয়া হলেও এবছর দেয়া হয়নি। দিনে তিনি খণ্ডকালীন ডিউটি করে যে কয়টাকা পান তা দিয়েই তার পরিবার চলে। এর কিছু অংশ সিটি করপোরেশনকে দেন।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জনসংখ্যার তুলনায় যে কয়টি গণশৌচাগার রয়েছে তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। এজন্য আরো বেশি গণশৌচাগার স্থাপন ও হাতছাড়া শৌচাগারগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন।’
তিনি শৌচাগারগুলোর সার্বিক পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, ‘জনসাধারণের তুলনায় শৌচাগার কম ও যথাযথ তদারকি না হওয়ায় এগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এর পরেও যে কয়টি রয়েছে এগুলোকে নারীদের ব্যবহার উপযোগী করে পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগজীবাণু ছড়াবে না।’
সিরাজুল ইসলাম আরো জানান, পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় তারা নতুন করে কোনো গণশৌচাগার নির্মাণ করতে পারছেন না। কিছু কিছু স্থানে জায়গা পাওয়া গেলেও সেখানে শৌচাগারের চাহিদা নেই।
নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন ও হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘একটি সভ্য জাতির মানদণ্ড হচ্ছে তাদের পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা। ঢাকা শহরের টাইফয়েড, আমাশয়, জণ্ডিসসহ ৪টি রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পয়ঃব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। শুধু ঢাকা শহরের কথা চিন্তা করলে চলবে না, ঢাকার বাইরের পাবলিক টয়লেট নিশ্চিত করতে হবে।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবেশবাদী সংগঠন পবা বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- পাবলিক টয়লেট বিষয়ক সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন, জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণস্থানে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীবান্ধব পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জনসচেতনতা, জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোবাইল টয়লেট বসানো; নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখার শর্তে পাবলিক টয়লেটগুলো ইজারা দেয়া; হাটবাজার ইজারার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি।

বিশেষ প্রতিবেদন সর্বশেষ