নিজস্ব প্রতিবেদক : রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশকারীদের কাছে থেকে ফরম পূরণ বাবদ বাড়তি টাকা আদায়। যে স্কুল সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে যতবেশি আদায় করতে পারবে তারা যেন ততো দামি স্কুল। নানা অভিযোগ, সমালোচনার মধ্যেও অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধে অসহায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত ফি না আদায়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ।
তবে অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, মন্ত্রণালয় আন্তরিক হলেই বন্ধ হতে পারে এই অতিরিক্ত ফি আদায়। তাদের মত হচ্ছে, পরীক্ষার এই ফি পাবে শিক্ষা বোর্ড। তাই স্কুলের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের সরাসরি বোর্ডে ফি জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য মতে, নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার ফি প্রতিপত্র ৬৫ টাকা, ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি ৩০ টাকা, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ফি ৩৫ টাকা, মূল সনদ ফি ১০০ টাকা, বয়েজ স্কাউট/গার্লস গাইড ফি ১৫ টাকা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ফি ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া যাদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নেই তারা ২৫০ টাকা এবং যাদের ব্যবহারিক পরীক্ষা আছে তারা ৩০০ টাকা কেন্দ্র ফি দেবে। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের বাড়তি আরও ১০০ টাকা দিতে হবে। ১৯ নভেম্বরের মধ্যে বিলম্ব ফি ছাড়া পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করে নির্ধারিত ফি বোর্ডে জমা দেয়ার কথা ছিল। এই সময়ের মধ্যে যারা দিতে পারেনি তাদের জন্য ১০০ টাকা বিলম্ব ফিসহ ফরম পূরণের ফি জমা দেয়ার শেষ সময় ২৫ নভেম্বর।
তবে নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতাই ছিল বেশি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বাড়তি ফি না নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে শিক্ষা বোর্ড নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ নেয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। উচ্চাদালতের সেই নির্দেশ আজ উপেক্ষিত।
এদিকে অতিরিক্ত ফি আদায়ের কোনো রশিদ দিচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণা, রশিদ না দিলে প্রমাণও মিলবে না। তাই অনেকটা বাধাহীন তারা। এই অবস্থায় সরকার নির্ধারিত এই ফি’র চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফি আদায় করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর দিলারা হাফিজ বলেন, ‘অতিরিক্ত ফি আদায় না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের বোর্ডের পক্ষ থেকে তদন্ত হচ্ছে। কোনো স্কুল অতিরিক্ত ফি আদায় করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রসঙ্গে দিলারা হাফিজ বলেন, ‘আমরা আদালতের নির্দেশ মানার জন্য সকলকে জানিয়েছি। যারা মানবে না তাদের তালিকা আদালতে দাখিল করা হবে।’
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলেই এই অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ হতে পারে মনে করেন অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা।
মিরপুরের একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মনসুর আলী লাভলু বলেন, ‘সরকার সব ক্ষেত্রেই ডিজিটাল ব্যবস্থা করছে। কিন্তু এখানে কেন নয়। এখন এতো শিক্ষার্থীর রেজাল্ট অনলাইনে হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরমের টাকা জমা সব হয় অনলাইনে। এসএসসি এবং এইচএসসির ক্ষেত্রে কেন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরীক্ষার অনেক আগেই শিক্ষার্থীদেরে রেজিস্ট্রেশন হয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর অনুসারে ব্যাংকে বা মোবাইলে টাকা জমা নিয়ে অনলাইনে প্রবেশপত্র দিলে কোনো স্কুল, কলেজ অতিরিক্ত ফি আদায় করতে পারবে না। পরীক্ষা না দেয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করতে পারবে না যেহেতু অনলাইনে নিজের প্রবেশপত্র নিজেই করে নিতে পারবে।’
অন্য একটি স্কুলের অভিবাবক প্রতিনিধি বলেন, ‘প্রায় সকল স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে রয়েছে সরকার দলীয় নেতারা। তারা নানাভাবে এই অতিরিক্ত ফি নিতে বাধ্য করেন স্কুলগুলোকে। অনেক স্কুলে শিক্ষকরা সরকার নির্ধারিত ফি থেকে অল্প বেশি নিতে চাইলেও ম্যানেজিং কমিটিতে থাকা নেতাদের জন্য সেটা সীমিত রাখা যায় না। এই টাকা যেহেতু অতিরিক্ত তাই স্কুলের নিয়মিত হিসাবের খাতায়ও ওঠে না। ভাগ বাটোয়ারা করে টাকা যায় নেতাদের পকেটে, স্কুলের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। নেতাদের সুযোগ বন্ধ হবে বলেই এক্ষেত্রে ডিজিটাল হচ্ছে না। এক অর্থে অতিরিক্ত ফি আদায়ে এ সুযোগ দিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই।’
জাফর উদ্দিন নামের এক অভিবাবক বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনেই আবেদন করে ফি জমা দেয় শিক্ষার্থীরা। এসএসসির ক্ষেত্রেও তো এই নিয়ম করা যায়, তারা কি বুঝেন না? রেজাল্ট তো ঠিকই অনলাইনে দিচ্ছে। যেহেতু পরীক্ষার ফি’র টাকা বোর্ড নেবে, সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক বা মোবাইলে টাকা জমা নেয়া পদ্ধতি চালু করা উচিৎ।’
অতিরিক্ত ফি নেয়া হচ্ছে স্বীকার করে রাজধানীর মিরপুরের ওয়াকআপ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার বলেন, ‘আমাদের স্কুলই কি শুধু অতিরিক্ত নিচ্ছে? সারাদেশে সব স্কুলেই নেয়া হয় সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে টাকা। তবে টাকা স্কুলের উন্নয়ন, কোচিং ও মডেল টেস্ট ফি বাবদ নেয়া হচ্ছে। বরং উল্টো প্রশ্ন করেন আপনি কী এসএসসি পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত ফি দেননি?’
আবুল বাসার বলেন, ‘এটাকে অতিরিক্ত বলা যায় না। এই ফি শিক্ষার্থী ও স্কুলের কাজেই লাগে। আমরা ছোট স্কুল বলে কম নেই। বরং অন্যান্য নামি স্কুলে আরো বেশি আদায় করা হয়।’ তবে এই ফি আদায়ের রশিদ কেন দেয়া হয় না জানতে চাইলে উত্তর দেননি তিনি।
আবুল বাসার বলেন, ‘আমাদের পাশেই ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে পরিচালিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল, সেখানেও অতিরিক্ত ফি নেয়া হয়। এই স্কুলের পরিচালনার সঙ্গে স্বয়ং বোর্ডের চেয়রাম্যানই সম্পৃক্ত। এটা (অতিরিক্ত ফি আদায়) আসলে সব স্থানেই হয়।’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘সব পাবলিক পরীক্ষায় নানা খাতের অজুহাতে স্কুল কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত অর্থ আদায় এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকরা অভিযোগ করলে বোর্ড, মাউশি ও মন্ত্রণালয় শুধু আশ্বাসই দেয়, ব্যবস্থা নেয়া হয় না।’ এজন্য মন্ত্রণালয়, বোর্ডকে আগে ঠিক হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে অনলাইনে ফি দেয়ার ব্যবস্থা চালুর দাবি জানান তিনি।
অভিভাবক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফরম পূরণের সঙ্গে কোচিং ও মডেল টেস্ট ফি অন্যান্য ফি মিলিয়ে ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে চার হাজার টাকা, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৪ হাজার ৭৯০, মণিপুর হাইস্কুলে সাড়ে নয় হাজার টাকা, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ৬ হাজার ৬৫২, রামপুরা একরামুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে ৬ হাজার ৫০০, মগবাজার নজরুল শিক্ষালয়ে ৮ হাজার, বাসাবোর কদমতলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ হাজার, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৫ হাজার, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল হাইস্কুলে ৫ হাজার ৯০০, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৫ হাজার, মিরপুরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ হাজার, বশিরউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৮ হাজার, মডেল একাডেমি ৮ হাজার, জান্নাত একাডেমি হাইস্কুলে ৭ হাজার ৭০০, সদরঘাটের পোগোজ স্কুলে ৬ হাজার, হাটখোলার মিতালী বিদ্যাপীঠ স্কুলে সাড়ে ৬ হাজার, আলিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ হাজার ৯০০ টাকা নেয়া হয়েছে।
তবে যদি কোনো পরীক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ফেল করে তবে টাকার অংক বাড়বে আরো কয়েকগুণ। স্কুল ভেদে কোনো শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করলে প্রতি বিষয়ের জন্য ৬ থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত টাকা নেয়া হচ্ছে ফরম পূরণের বাইরে।