নিজস্ব প্রতিবেদক : ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনআইএ) প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরকালে ১১ জঙ্গির ব্যাপারে তথ্য দেয়ার পাশাপাশি ১৫টি মোবাইল নম্বর দিয়েছে ঢাকাকে। এনআইএ গোয়েন্দা দল ওই নম্বরগুলোর সূত্র ধরে তদন্ত করার জন্য পুলিশ ও র্যাবকে অনুরোধ করেছে। তালিকা বিনিময়ের সময় পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়।
র্যাবের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এনআইএর ওই তালিকা ও মোবাইল ফোন নম্বর ধরে তদন্ত করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র্যাব-পুলিশ। ১৫টি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হামলার পরিকল্পনা করেছে ভারত ও বাংলাদেশে অবস্থানকারী জঙ্গি নেতারা। কোথায় কিভাবে রাখা হবে বোমা? কে বা কারা আত্মঘাতী হবে? ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কিভাবে গোপন যোগাযোগ রাখতে হবে? ধর্মীয় নেতারা যেসব নির্দেশ দেবে তা বাস্তবায়ন করতে হলে কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরে জঙ্গি যোগাযোগে বেশ কিছু পরিকল্পনার তথ্য পেয়েছে র্যাবের গোয়েন্দা দল। পাওয়া তথ্য যাচাইয়ের জন্য তারা এনআইএকে অবহিত করেছেন। বৃহস্পতিবার ভারতে যাওয়া গোয়েন্দা দল এ বিষয়ে তথ্য বিনিময় করেছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
ওই প্রতিনিধি দলে থাকা র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ দেশত্যাগের আগে বলেন, ‘এনআইএ সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে ১১ জঙ্গিসহ ৪১ অপরাধীর তালিকার পাশাপাশি এরকম তথ্য সম্বলিত মোবাইল নম্বরগুলো র্যাবকে দেয়। আর র্যাবের পক্ষ থেকে এনআইকে দেয়া হয় ১০ জঙ্গির তালিকা। এনআইয়ের দেয়া মোবাইল ফোন নম্বরে আন্তঃদেশীয় জঙ্গি কথোপকথনের তথ্য যাচাই বাছাই চলছে। তদন্তে ইতোমধ্যে এনআইয়ের তথ্যের কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে।’
আবুল কালাম আজাদ আরো বলেন, ‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওপার-এপার বাংলার জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করছে। সেই সঙ্গে অন্য অপরাধীরাও মোবাইল ফোনে আলাপের মাধ্যমে কী ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাতে পারে তার আগাম তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে জঙ্গিদেরও নজর রয়েছে। ইসলামি দলগুলোর নেতারা জঙ্গিদের ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। জঙ্গিরা ভবিষ্যতে বিস্ফোরক ও বোমার সরঞ্জাম মজুদ করার মতো তথ্যও মোবাইল ফোনে আদান-প্রদান করেছে। ১৫টি মোবাইল ফোনের জঙ্গি কথোপকথনের সূত্র ধরে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। বিশেষ করে ভারতে অবস্থানকারী জঙ্গিদের কিছু পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব পরিবারের সদস্যদের অনেকেই আত্মঘাতী দলের সদস্য। জঙ্গিদের স্ত্রীরাও অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এরা জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। এই নারী জঙ্গিদের মাধ্যমেও জঙ্গি হামলা চালানো হতে পারে। এরকম অনেক জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার কথা মোবাইলে আলাপ করে জঙ্গিরা।
গোয়েন্দা তথ্য মতে, গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে একটি বাড়িতে জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে দু’জন নিহত হয়। ঘটনার পর এনআইএ তদন্তে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সম্পৃক্ততার কথা জঙ্গিদের মোবাইল ফোনের আলাপের সূত্র ধরেই জানতে পারে। বর্ধমান বিস্ফোরণে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে শেখ রহমতুল্লাহ সাজিদসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও রয়েছে বলে দাবি করে এনআইএ। একই সঙ্গে বাংলাদেশে অপহরণ, চাঁদাবাজির তথ্যও মোবাইল ফোনে আদান প্রদান হয়।
জানা গেছে, দুর্ধর্ষ ৪১ অপরাধীর তালিকা ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়ার সময় র্যাব সদস্যরা মোবাইল ফোনে বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও হত্যার নির্দেশনা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আসে বলে এনআইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। সেইসঙ্গে র্যাবের পক্ষ থেকে এনআইকে দেয়া পলাতক ও সাজাপ্রাপ্ত ১০ জঙ্গির মোবাইল ফোনে গোপন আলাপের তথ্য নিয়েও কথা বলেন দু’দেশের গোয়েন্দারা। ওই জঙ্গিদের অধিকাংশই বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে রয়েছে বলে তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। তবে সাম্প্রতিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে তাদের অবস্থান বদলে এ মুহূর্তে অন্য কোথাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের আশ্রয়স্থল ও বিচরণক্ষেত্র নজরদারিতে রাখতে সহায়তা চাইছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার ভারতে যাওয়া বাংলাদেশের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল মূলত দু’দেশের জঙ্গি ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশি গোয়েন্দা প্রতিনিধি দলের প্রধান।
এর আগে এনআইয়ের গোয়েন্দারা বাংলাদেশে আসার পর তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের জানান, ভারতের সন্দেহ, ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশেই দুষ্কৃতকারীরা রয়েছে। এদের খুঁজে বের করা দরকার। তাদের এই আবেদন উড়িয়ে দেয়ার মতো নয় বলে আমরা মনে করি। ভারত ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ‘দুষ্কৃতদের’ ব্যবহার করতে না দেয়ার বিষয়ে দুদেশই একমত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের জঙ্গি ও অপরাধীরা ভারতের কলকাতা, মুর্শিদাবাদসহ আশেপাশের এলাকায় আত্মগোপন করার পাশাপাপাশি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, নেপাল, দুবাই ও শ্রীলঙ্কায়ও আত্মগোপন করে আছে। তারা মোবাইল ফোনে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মাঝেমাঝে ভিন্ন পরিচয়ে দেশেও আসে। টেলিফোনের মাধ্যমেই সহযোগী ও স্বজনদের সঙ্গে তারা কথা বলে। অর্থ লেনদেনও করে। এমন নানা তথ্য মিলিয়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন বিভিন্ন মামলায় পলাতকদের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয়স্থল সম্পর্কে। ভারতে অবস্থানরত অপরাধীদের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে তথ্য চালাচালি হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে তাতে ফলও মিলেছে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার সূত্রে ভারতীয় গোয়েন্দা দল বাংলাদেশে আসায় তাদের কাছে নতুন করে কিছু অপরাধীর তথ্য দেয়া হয়েছে। জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ অপরাধী মিলিয়ে মোট ৫১ জনের তালিকা আপাতত র্যাবের পক্ষ থেকে এনআইএ প্রতিনিধি দলকে দেয়া হয়েছে।
যে ১০ জন দুর্ধর্ষ জঙ্গির তথ্য দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আবু সাইদ ওরফে মাহফুজ ওরফে সোহেল, মাওলানা তাজ উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জাহিদুল ইসলাম ওরফে সুমন ওরফে বোমারু মিজান ওরফে হারুন ওরফে কামরুল, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহীদ, আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে আনোয়ার হোসেন ওরফে ফারুক ওরফে সাখাওয়াত ও তরিকুল ইসলাম ভারতের কোথায় আশ্রয় নিয়েছে সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই গোয়েন্দাদের হাতে। তাদের ছবিসহ বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে তালিকায়। তাদের অনেকেই মোবাইল ফোনে কী ধরনের আলাপ করেছে তা জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।
তথ্যমতে, ২০০৫ সাল থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ ও জনবল দিয়ে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম। সেই সঙ্গে আন্তঃদেশীয় একটি জঙ্গি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে টেলিফোন ও কয়েক জঙ্গি সদস্যের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের কথা জানিয়ে এনআইএ প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, শেখ হাসিনাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যার ছকও কষছে জঙ্গিরা। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর হামলাসহ ব্যাপক নাশকতার পর ভারতে পালানোর পরিকল্পনা করে জঙ্গিরা। একই সঙ্গে জঙ্গি বিস্তার ঘটাতে আন্তঃদেশীয় গোপন শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ছে তারা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সব জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরাও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
গোয়েন্দা তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় জঙ্গিরা বিশেষ নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এ জন্য ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গিরা পূর্বাঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট। তারা নেপাল ও বাংলাদেশের রাজশাহীর একটি অংশেও শক্ত ঘাঁটি গাড়তে আগ্রহী।