আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অবশেষে তাৎপর্যপূর্ণ আরব বসন্তের সলিল সমাধি হতে যাচ্ছে মিসরে। তিউনিসিয়ার বুয়াজিজির শরীর থেকে যে আগুনের শিখায় পুড়ে গেল গোটা আরব জাহান সেই আগুনের এমন করুন পরিণতি মিসরবাসী মেনে নিতে পারছে না। শতাধিক আন্দোলনকারীর মৃত্যু আর রক্ত স্রেফ ধুলায় মিশে গেল হোসনী মোবারককে হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত সীমায় দাড়িয়ে মিসরের জনগণ প্রতিবাদে ফেটে পরেছিল স্বৈশাসকের বিরুদ্ধে। জনতার দাবি ছিল স্বাধীন, গণতান্ত্রিক এবং যোগ্য নেতার শাসন, যা মিসরকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চোরাপথ দিয়ে হোসনী মোবারকেরাই জয়ী হয়ে বারবার হতাশ আপামর জনতার ভাগ্যে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রইবে।
আরব বসন্তের সেই উত্তাল সময় ২০১১ সালে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের সময় ২০৯ জন মিসরীয় বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছিলেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ৮৬ বছরের হোসনী মোবারক এবং সাবেক সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত এক বিচারে মোবারককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করাও হয়েছিল। কিন্তু গত বছর আপিল বিভাগ কৌশলগত কারণ দেখিয়ে ওই রায় বাতিল করে পুনর্বিচারের নির্দেশ দেন। আর সেই বিবেচনার জের ধরেই গত শনিবার তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি মাহমুদ কামেল আল রাশিদি এখনও রায় লেখা হয়নি বলে বিচার স্থগিত করেন।
সাবেক এই স্বৈরশাসকের বিচার প্রায় এক বছর ধরে চলে। এসময় একবার গুজব ওঠে যে হোসনী মোবারকের শারিরীক অবস্থা ভালো নয়, তিনি যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারেন। যদিও এই গুজবটি মোবারকের আইনজীবিরাই প্রথম ছড়ায়। আর এই গুজবের জের ধরে মোবারক ও তার অনুসারীরা বিচার ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য বেশ সময় পায়। তৎকালীন সময়ে মিসরের বিক্ষোভকারীরা বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী না করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাদের ভয় ছিল যে, বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে হোসনী মোবারক হয়তো বিচার থেকে খালাস পেয়ে যাবেন।
তবে মোবারকের বিচারের এই সময়ের দিকে যদি একটু তাকানো যায় তাহলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। যা দেশটিকে একের পর এক নাটকের দিকে নিয়ে গেছে। মুসলিম ব্রাদারহুড এসময় রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশ করে বেশকিছু এজেণ্ডাকে সামনে রেখে। উল্লেখ্য, হোসনী মোবারকের আমলে মুসলিম ব্রাদারহুড ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মোবারক বাহিনীর হাতে। আর এই নির্যাতনকেই মানবিক হাতিয়ার বানিয়ে সংসদের অর্ধেক আসন দখল করে ব্রাদারহুড। নাটকের এক পর্যায়ে ব্রাদারহুডের হয়ে মিসরের ক্ষমতায় বসেন মোহাম্মদ মুরসি। যদিও মুরসি বেশিদিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই পদ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন মুরসি। মজার বিষয় হলো, যে মুসলিম ব্রাদারহুড সংসদের অর্ধেক আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল, মুরসির ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী ব্রাদারহুডের সমর্থকদের গণহারে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। রাজধানী কায়রোর দুইটি স্কয়্যার থেকে প্রায় এক হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং মুরসিকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
মিসরের এই গোলযোগের ভেতর দিয়ে হঠাৎ করেই ক্ষমতায় আসেন সেনাবাহিনী প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। হোসনী মোবারকের আমলে সিসিকে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান করা হয়েছিল এবং মুরসির সময়ে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বানানো হয়। এই সিসিই মুরসিকে ক্ষমতা থেকে বহিস্কার করে নিজের হাতে পুরো ক্ষমতা নিয়ে নেন। সিসি এসময় পুতুল সরকার হিসেবে নিয়োগ দেন আদলি মানসুরকে। যদিও অধিকাংশ মিসরীয় বিশ্বাস করেন যে, সিংহাসনের মূল মালিক সিসি। চলতি বছরের মে মাসে ভোটাভুটির মাধ্যমে মিসরীয়রা তাদের চতুর্থ নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন।
এখন মিসরীয় জনগণের দাবি, তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টই হোসনী মোবারককে সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়ার পেছনে কলকাঠি হিসেবে কাজ করছেন। শনিবার রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ রাজধানী কায়রোর তাহির স্কয়্যারে সমবেত হন এবং বিক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে একজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। আবারও রক্তে রঞ্জিত হয় কায়রোর রাজপথ। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জল-কামান ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনী। জবাবে বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু এখন মিসরবাসীর মনে একটাই প্রশ্ন, তাহলে কি প্রচ্ছন্নভাবে এতোদিন তারা হোসনী মোবারকের শাসনেই ছিল?