নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বৃত্তাকার নৌপথ প্রকল্প নয় বছরেও সচল করতে পারেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ২০০৫ সালের ৩ মার্চ উদ্বোধন হয়ে আজ পর্যন্ত কোনো সুফল নেই ‘সদরঘাট-আশুলিয়া নৌপথ’ প্রকল্পের।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩টি নিচু সেতু। এগুলো হলো- বিরুলিয়া, আশুলিয়া, প্রত্যাশা, কামারপাড়া, টঙ্গী-১ ও ২ ব্রিজ, টঙ্গী রেল ব্রিজ-১ ও ২, ত্রিমুখ, কালীগঞ্জ, ইছাপুরা, ডেমরা, মিরপুর পুরনো ব্রিজ। সেতুর প্রতিবন্ধকতায় প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া নৌপথের উভয় তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, প্রভাবশালী মহল ও রাজনীতির ছত্রছায়ায় অবৈধ দখলের মহোৎসব চলছে। হাউজিং প্রকল্পের পাশাপাশি ইট-বালি ব্যবসায়ীরা ট্রলারযোগে বালি এনে নদীর পাড়ে ফেলছে। ফলে উভয় পাড় থেকে নদীকে সরু করে ফেলা হচ্ছে।
এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ভরাট করা জমি উদ্ধারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়। শুধু লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় দখল হয়ে যায়। সবমিলে ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ বাস্তবায়নের কাজ থেমে গেছে।
অথচ ৩০ কিলোমিটার এই প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য ব্যয় হয় পাঁচ লাখ টাকা। সকাল-বিকেল চার দফায় লঞ্চ চলবে বলে ঘোষণাও দেয়া হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২০০৭ সালে প্রকল্পের পরিধি বাড়িয়ে দ্বিতীয় পর্যায় অনুমোদন করে।
এ পর্যায়ে টঙ্গী-কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার প্রকল্প এলাকা বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হয় ৪৮ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫৪ কোটি টাকা করেছে। মূলত রাজধানীর যানজট কমাতেই ৯ বছর আগে এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল।
রাজধানীর বৃত্তাকার নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স সূত্রে জানা গেছে, সড়কের এপ্রোচ, জমি অধিগ্রহণ, রেলওয়ের ৩টি সেতুসহ নানা জটিলতায় তুরাগ নদীর ওপর তৃতীয় টঙ্গী সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে করে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৃত্তাকার নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ।
টাস্কফোর্সের নির্দেশনা অনুযায়ী সওজ অধিদপ্তর, বনানী-টঙ্গী জয়দেবপুর সড়ক উন্নয়ন (সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৩টি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইং। সেতুটিগুলো নির্মাণ করা হলে তুরাগ নদী দিয়ে ভ্যাসেলসহ (বড় জাহাজ) বিভিন্ন নৌযান সহজে চলাচল করতে পারবে। রাজধানীর যানজট সমস্যা দূর করতে সহায়ক হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও রেলপথ বিভাগের পরিকল্পনা উইং সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
টাস্কফোর্স রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ নির্মাণের লক্ষ্যে নদীগুলোর ওপর ১৩টি সেতুর উচ্চতা বাড়াতে নির্দেশনা দেয়। এ নির্দেশনা অনুযায়ী তুরাগ নদীর স্ট্যান্ডার্ড হাই ওয়াটার লেবেল থেকে ২৫ ফুট (৭.৬২ মিটার) ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স এবং ১০০ ফুট হরাইজন্টাল (দুই পিলারের মাঝখানে) ক্লিয়ারেন্স রেখে তৃতীয় টঙ্গী সেতু নির্মাণ করার কথা। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তাবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই।
সূত্র জানায়, টাস্কফোর্সের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১১ সালের ৪ আগস্ট নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদারের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভায় ঢাকার চারদিকে নদীগুলোর ওপর অবস্থিত সেতুগুলোর উচ্চতা বাড়াতে নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা ও জটিলতা নিরসনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্ট্যান্ডার্ড হাইওয়াটার লেভেল কমিয়ে তৃতীয় টঙ্গী সেতু নির্মাণ করা যায় কি-না এ বিষয়ে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ টাস্কফোর্সকে জানাবে। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও টাস্কফোর্সকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার নৌপথের মোট দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সদরঘাট-আশুলিয়া ৩০ কিলোমিটার, আশুলিয়া-টঙ্গী-কাঁচপুর ৪০ কিলোমিটার এবং কাঁচপুর-নারায়ণগঞ্জ-সদরঘাট ৪০ কিলোমিটার।
বৃত্তাকার নৌপথ চালুর প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নৌপথের প্রথম পর্বের (সদরঘাট-আশুলিয়া) কাজ শেষ হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ৩৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্বের (আশুলিয়া সেতু-টঙ্গী-কাঁচপুর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার) কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালে। ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সম্ভব হয়নি। মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়।
২০০২ সালে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্প হাতে নেয়, যার নাম দেয়া হয় ‘ঢাকা শহরের চারদিকে নৌপথ চালুকরণ, যানজট নিরসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’। প্রকল্পের প্রথম পর্ব চালুর পর মালবাহী কার্গো চলাচলে বড় ধরনের সফলতা আসে। প্রতিদিন সাত থেকে আট হাজার ঘনফুট পাথর, সিমেন্ট, ইট ও বালুবাহী কার্গো চলাচল করেছিল। এসব মালামাল কার্গো থেকে সরাসরি ট্রাকে উঠিয়ে নেয়া হতো।
এছাড়া সড়কপথে নেয়ার সমস্যার কারণে অনেক ব্যবসায়ী সদরঘাট থেকে নৌপথে চাল-ডাল এমনকি আসবাবও এই পথে আনা-নেয়া শুরু করে। কিন্তু উদ্বোধনের দু’মাসের মাথায় ‘পর্যাপ্ত গভীর নয়’ বলে নদীতে লঞ্চ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। নৌযান চলাচল এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। নদীর তলদেশ ১২০ ফুট প্রশস্ত করার কথা বলা হলেও করা হয় ৯০ ফুট। কথা ছিল সারা বছর কমপক্ষে আট ফুট পানি থাকবে। কিন্তু শুকনো মৌসুমে পথটির কোথাও কোথাও চার ফুট পানিও ছিল না তখন।
অন্যদিকে নৌযান চালু না হওয়ায় বৃত্তাকার নৌপথের আমিনবাজার থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে নদীর একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নদী ভরাট করে অনেক স্থানে নদীর জায়গায় অবৈধ স্থাপনা, রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট করা হয়েছে। এতে নৌযান চলাচলের স্বাভাবিক প্রশস্ততা কমে গেছে।
বৃত্তাকার নৌপথে যাত্রী ওঠানামার জন্য ১৪টি ল্যান্ডিং স্টেশন রয়েছে। যাত্রী চলাচল না করায় চরম অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হতে চলেছে এগুলো। পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা তদারকির কোনোটিই না হওয়ায় অধিকাংশ ল্যান্ডিং স্টেশন এখন অপরাধীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। স্টেশনের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র আবর্জনা। দরজা-জানালার কপাট ভাঙা। আবার কোনো জানালার রডও খুলে নেয়া হয়েছে।
নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘আমাদের নৌ-যানের সংখ্যা কম, যাত্রীরাও নৌপথে চলাচলে সেভাবে আগ্রহী হয়নি। অন্যদিকে বৃত্তাকার নৌপথে কিছু জায়গায় ব্রিজের উচ্চতা অনেক কম হওয়ায় নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত প্রধান তিনটি কারণে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে পর্যায়ক্রমে এসব সমস্যা সমাধান করে কার্যকর বৃত্তাকার নৌপথ চালু করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।
বৃত্তাকার নৌপথ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আমরা নদী খনন, ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ যথাসময়ে শেষ করেছি। কিন্তু এখনও বড় নৌ-যান চলাচলে সড়কপথে ব্রিজ ও রেল ব্রিজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অন্তত ১৩টি স্থানে ব্রিজের উচ্চতা অনেক কম। উচ্চতা কম হওয়ায় এর নিচ দিয়ে বড় নৌ-যান চলাচল করতে পারছে না।’ বৃত্তাকার নৌপথ কার্যকর করতে এসব ব্রিজের উচ্চতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।