নিজস্ব প্রতিবেদক :
বদলে যাচ্ছে ছিনতাইকারীদের টার্গেট। আগে হাজার বা লাখ টাকার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও এখন ছিনতাইকারীদের চোখ কোটি টাকায়। রোববার রাজধানীর মিরপুরে প্রশিকা ভবনের সামনে এমন একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীরা চালককে গুলি করে ৮৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বেসরকারী অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ ও মোবাইল কোম্পানি এয়ারটেলের এজেন্ট ‘মোনাডিক’ এন্টারপ্রাইজের কর্মীরা ওই টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যাচ্ছিলেন।
রোববার রাজধানীতে তিন ঘটনায় ছিনতাই হয়েছে মোট এক কোটি ১১ লাখ টাকা। তবে সোমবারও ওই টাকা উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ধরা পরেনি ছিনতাইকারী চক্রের কোনো সদস্য।
জানা গেছে, মিরপুরের প্রশিকা ভবনের সামনে গুলি করে প্রায় কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় একদল পেশাদার ছিনতাইকারী জড়িত। তাদের প্রত্যেকের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র (পিস্তল-রিভলবার) ছিল। ঘটনায় সাতটি মোটর সাইকেল ব্যবহার হয়। প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুজন করে ছিল। ঘটনাস্থলের চারদিকে তাদের অবস্থান ছিল। কেউ কেউ পুলিশ ও র্যাবের গতিবিধি খেয়াল করছিল। আবার কেউ কেউ ব্যস্ত ছিল প্রাইভেটকারে থাকা বেসরকারি অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ ও এয়ারটেলের এজেন্ট ‘মোনাডিক’ এন্টারপ্রাইজের কর্মীদের নিয়ে। তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারটি আগে থেকে অনুসরণ করছিল একটি মোটরসাইকেল। পরে পরিস্থিতি অনুকূল মনে করে চালক জাহিদ হোসেনকে গুলি করে ৮৭ লাখ টাকা ছিনতাই করে তারা দ্রুত একই মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। এভাবেই কোটি টাকার ছিনতাই মিশন সফল করে চক্রটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। এর কারণ সম্পর্কে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে পেশাদার দূর্বৃত্তরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতারারই নিজস্ব প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করে। এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি তেমন একটা নেই বলে এসব অপরাধি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এসব ছিনতাইকারী বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে মোটা অংকের টাকা লুট করতে চাইছে। এ কারণে লাখ লাখ টাকা পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মিরপুরের ঘটনার ব্যাপারে রুপনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মতলবুর রহমান বলেন, ছিনতাইয়ের ৮৭ লাখ টাকা উদ্ধার হয়নি। ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তৌফিক হাসান নামে প্রতিষ্ঠানটির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাদি হয়ে মামলা করেছে। এজাহারে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার নিসারুল আরিফ বলেন, এক কোটি টাকা নিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে হলে পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া উচিৎ। এ ঘটনায় আগে থেকে পুলিশের সহযোগিতা নেয়া হয়নি। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের সনাক্ত করা যায়নি। তবে ছিনতাইকারীরা আগে থেকেই ওই গাড়ি ‘ অনুসরণ’ করছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত চলছে।
ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উঠিয়ে কিংবা ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়া নগরবাসির জন্য ডিএমপিতে বিশেষ সেবার ব্যবস্থা করলেও অনেকেই বিভিন্ন কারণে সেই সুবিধা নিতে চান না। ভুক্তভোগিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের ধারনা থানা পুলিশের কতিপয় সদস্যদের সঙ্গে ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের যোগাযোগ রয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রমতে, গত কয়েক মাসে ছিনতাইকারীদের গুলিতে চার ব্যবসায়ী মারা গেছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। সোমবার ভোরেও সায়েদাবাদ এলাকায় বাস টার্মিনালের কাছে রাকেশ চন্দ্র সরকার নামে সিলেটের একটি হাসপাতালের চিকিৎসক ও তার বন্ধু সেলিম আহমেদকে ছুরি মেরে ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় আহত দু’জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুরে গুলিস্তান এলাকায় আজাহার আলী নামে আরো এক ব্যবসায়ীকে মারধর করে ২০টি মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।
এর আগের দিন রোববার ভোরে মিরপুর আব্দুল আজিজ নামে এক গরিব দিন মজুর বাগেরহাটের একটি গ্রাম থেকে ঢাকা ভোরে গাবতলি নেমে মিরপুর এক নম্বর এলাকায় আসার পর ছিনতাইকারীরা তাকে মারধর করে কাছে থাকা দুই হাজার টাকা নিয়ে নেয়।
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই বিকালে মিরপুরের প্রশিকা ভবনের সামনে অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ ও মোবাইল কোম্পানি এয়ারটেলের এজেন্ট ‘মোনাডিক’ এর গাড়ি চালক জাহিদ হোসেনকে গুলি করে ৮৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এর আগের দিন ভোরে পুরান ঢাকার চকবাজার থানা এলাকায় মুত্তাকিম হোসেন বাবু এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে প্রায় অর্ধলাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় একদল ছিনতাইকারী। এভাবে গত ১৭ জুন রাজধানীর মুগদা এলাকায় ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ী রুবেল হককে গুলি করে নিয়ে যায় ৬ লাখ টাকা ছিনতাই হয়।
একই দিন শ্যামপুরের ধোলাইখাল এলাকায় দোকান মালিক জাকির হোসেনকে গুলি করে ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায় ৫০ হাজার টাকা। গত ৮ জুন ধানমণ্ডি এলাকায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের একজন কর্মচারীকে (মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে) দেখিয়ে ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায় ২৬ লাখ টাকা। ৭ জুন রায়েরবাগে ছিনতাইকারীদের নিহত হন মোবাইল রিচার্জ দোকানের কর্মচারী রাসেল। ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে নিয়ে যায় ২১ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ৫ জুন রামপুরায় বিকাশ এজেন্ট কাজী রমজান আহত হন ছিনতাইকারীদের গুলিতে। তার কাছ থেকে নিয়ে যায় ৪ লাখ টাকা। ২৮ মে গুলিস্তান এলাকায় গুলি করে ও ককটেল ফাটিয়ে ছিনতাইকারীরা ফল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে নিয়ে যায় ৩ লাখ টাকা। ১৯ মে খিলগাঁও এলাকায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী জহির আহমেদ। ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় ৭ লাখ টাকা। ২০ মে দক্ষিণ বনশ্রীএলাকায় ছিনতাইকারীদের গুলিতে আহত হন বিকাশ এজেন্ট সানাউল্লাহ। তার কাছ থেকে নিয়ে যায় ৭ লাখ টাকা। ১৪ মে দয়াগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন কাঁচামাল ব্যবসায়ী এনামুল হক। একই দিন রামপুরায় ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায় দেড় লাখ টাকা। ছিনতাইকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে।