নিজস্ব প্রতিবেদক :
বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ছাত্রলীগ কর্মীরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরলেও তাদের গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকা আসামিদের মধ্যে চারজন ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছে বলে জানা গেছে। সাজাপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা অধরা ধাকায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন বিশ্বজিতের পরিবার ও মামলাটির সাক্ষীরা।
মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পূর্ণ হলো। ২০১২ সালের এই দিনে ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে পুরান ঢাকায় দরজি বিশ্বজিৎ দাস নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীরা।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা ওই হত্যা মামলার ২১ আসামির বিরুদ্ধে আদালতের রায় হয়। আদালত আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত রাজন তালুকদার ও নূরে আলম লিমন এবং যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত খন্দকার ইউনুস আলী, মনিরুল হক পাবেল, তারিক বিন জোহর তমাল, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের তাহসিন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম (২), কামরুল হাসান, ইমরান হোসেন ও মোশাররফ হোসেন পলাতক রয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, ইমদাদুল হক, কাইয়ুম মিয়া ও সাইফুল ইসলাম এবং যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পাওয়া এইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে।
এরা সবাই বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছেন, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম দাস বলেন, ‘দুই বছর হয়ে গেছে তবু বেশির ভাগ আসামি ধরা পড়ল না। আমি পুরান ঢাকায় বসবাস করি। রাস্তায় বের হলেই ভয় ও আতঙ্ক কাজ করে।’
বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত দাস বলেন, ‘আদালত সাজা দিয়েছে ঠিকই। তবে সেই সাজা দিতে পারে কিনা জানি না। অনেক আসামি বাইরে। লোকমারফত হুমকি ধামকিও পাচ্ছি। আমরা গরীব মানুষ। আমারা তো কিছুই চাইনি। মরার আগে ছেলের হত্যাকারীদের সাজা দেখে যেতে চাই।’
বিশ্বজিৎকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন যিনি, সেই রিকশাচালক রিপন সরদার গত দুই বছর ধরেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সাক্ষীতে তাদের বিচার হইছে। তাগো লোক বাড়িতে গিয়া আমারে মারছে। কী করে এই ভয়ে বাড়িতেও যাই না। পুলিশরে বলছি, তারাও কিছু করে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি রাজন চন্দ্র তালুকদার ভারতের কলকাতায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি ওই দেশের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কয়েক মাস ধরে রাজন তালুকদার তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টি সচল করেছেন। সেই ফেসবুকে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গে তোলা পুরাতন ছবি আপলোড করেছেন।
অতীতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও সেখানে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূরে আলম লিমন পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রাজধানীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছাত্রলীগের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, ১৫ আগস্টরের কর্মসূচিতে তাকে রাজধানীতে দেখা গেছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লিমনের এক বন্ধু ও ছাত্রলীগ নেতা জানিয়েছেন, লিমন মিরপুরের কোনো একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত রয়েছেন। মাঝে মধ্যে তিনি সুযোগ পেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাঁজা সেবন করতে আসেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি কামরুল হাসান ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়ার পরই ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সবুজের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। শুরু করেন প্রশ্ন ফাঁস ও এসএমএস বাণিজ্য। সবুজ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও তার নেটওয়ার্ক ধরে রেখেছে কামরুল। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তার সে অপকর্ম বন্ধ হয়নি। রাত ৯টার পরে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে নিয়মিত আড্ডা দেন তিনি। গত ৩১ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ দেন তিনি। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। থাকেন রাজধানীর আজিমপুর এলাকায়।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামি আল আমিন শেখ মামলার রায় হওয়ার পরেই ভারতের কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আল আমীনের এক বন্ধু ও জবি ছাত্রলীগের এক নেতা এ তথ্য জানান।
হত্যা মামলার আরেক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওবায়দুল কাদের তাহসীন ভারত দিয়ে দুবাই পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।
তাহসীন বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের নেতা ছিলেন এবং তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি ছিলেন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইমরান হোসেন গত রমজানে ছাত্রকল্যাণ সংগঠনের ইফতার পার্টিতে যোগ দেন। তাকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর সঙ্গেও দেখা গেছে বলে জানা গেছে।
যাবজ্জীন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তারিক বিন জোহর তমাল মামলার রায় হওয়ার পরেই মালয়েশিয়া চলে যান। তার কয়েক দিন পর আবার সিংগাপুর চলে গেছেন বলে ছাত্রলীগের একটি সূত্রে জানা গেছে।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি ইউনুস আলী মাগুরা ও ঢাকায় ঘুরে ফিরছেন। ঢাকায় এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে বলে জানা গেছে।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত মোশারেফ হোসেন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে থাকেন। নারিন্দার ভুতের গলির একটি মসজিদে জুমার নামাজে তাকে প্রায়ই দেখা যায়।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আজিজুর রহমান খুলনায় গ্রামের বাড়ির কাছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকছেন। ঢাকায় দলীয় কর্মসূচিতে তাকে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র। গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আলাউদ্দিন আছেন গাজীপুরে। একটি পোশাক খারখানায় চাকরি করেন তিনি। মাঝেমধ্যে রাজধানীর ফার্মগেটে নাদিম নামে এক বন্ধুর কাছে আসেন।
আরেক যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মনিরুল হক পাবেলকে চার/পাঁচ মাস ধরে দেখা যাচ্ছে না। দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে পাবেল দেশ ছেড়েছে বলে খবর ছড়িয়েছে। রফিকুল ইসলাম রাজধানীতে গা ঢাকা দিয়ে চলছেন বলে জানা গেছে।
দণ্ডপ্রাপ্তদের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে আসামিদের যে দণ্ড দেয়া হয়েছে, আমরাও সেই দণ্ডের বাস্তবায়ন চাই। তবে ছাত্রলীগের সাথে ওই আসামিদের কখনোই সম্পর্ক ছিল না এখনও নেই। তাদের প্রশ্রয় দেয়ার কথা প্রশ্নই আসে না।’
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাটির তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা, ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিচারপূর্ব আসামি গ্রেপ্তার করে আমরা আদালতে দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনও দিয়েছি। এরপর আদালত আসামিদের ঠিকানায় সংশ্লিষ্ট থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠিয়েছেন। এটি ওই থানার এখতিয়ার। তবে আমরাও মামলার আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’
নিরাপত্তার ব্যাপারে নড়িয়া থানার ওসি শেখ কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বজিতের পরিবার বা সাক্ষী কেউ নিরাপত্তা চাইলে অবশ্যই নিরাপত্তা দেয়া হবে। আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ সবসময় পরিবারটির খোঁজ-খবর রাখছে।’