নিজস্ব প্রতিবেদক :
আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি নারীর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কোনো মেয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে না-এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
‘বেগম রোকেয়া পদক-২০১৪’ বিতরণ ও বেগম রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কোনো মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ বাংলাদেশে পাবে না- সে রকম থাকবে না। কোনো মেয়ে নিরক্ষর থাকবে না।
“কারো দিকে তাকাতে হবে না। আমরা নিজেরাই এগিয়ে যাব।”
মেয়েদের সমান সুযোগ করে দিতে না পারলে সমাজের উন্নয়ন হবে না বলেও মনে করেন শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে চলতি বছরের রোকেয়া পদক অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও গোলাপ বানুর হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
নারী শিক্ষা বিস্তার, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী উন্নয়নসহ অসহায় ও দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই দুই নারীকে এ বছর রোকেয়া পদক দেওয়া হয়েছে।
দুজনকেই একটি করে স্বর্ণপদক, সনদ আর এক লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে।
১৯৭২ সালের নারী পুনর্বাসন বোর্ডের সদস্য হিসাবে মমতাজ বেগম সারাদেশে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) হিসাবে দায়িত্ব পালন করা এই নারী ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদেরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৩ এপ্রিল কুমিল্লায়। ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ১১ দফাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। এর আগে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, নারী প্রগতি সংঘ, জাসদ, নৌ কমান্ডো ও নারী ফাউন্ডেশনের সম্মাননাও তিনি পেয়েছেন।
১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্ম নেওয়া গোলাপ বানুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সমবায় সমিতির মাধ্যমে তিনি নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রখেন।
কয়েকজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৬ সালে গোলাপ বানু বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি চালু করেন, যে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা এখন ৩৬ হাজার ৬৭৩ জন।
সমবায়ের মাধ্যমে এ সমিতি গত ১৮ বছরে ১৪৪ কোটি টাকার পুঁজি গড়ে তুলেছে।
গোলাপ বানুর উদ্যোগে এ সমিতির সদস্যদের শিক্ষায় বর্তমানে ছয়টি স্কুলও পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া অসহায় ও দুস্থ নারীদের ধাত্রী সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছেন তিনি।
বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মৃতিতে ১৯৯৫ সাল থেকে এই পদক প্রবর্তন করে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এই পদক বিতরণ করা হয়।
প্রথম বছর বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ এই পদক পান। পরের বছর দেওয়া হয় কবি সুফিয়া কামাল ও নীলিমা ইব্রাহিমকে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ৩৭ জনকে সরকার এই পদক দিল।
প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়র পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে গোলপ বানু বলেন, “আমরা নারীরা পিছিয়ে নেই। আমরা সাহস করি না, আমরা ভয় পাই। আমরা কেন ভয় পাবো? মন্ত্রী, এমপি, জজ, ব্যারিস্টার সব মহিলা। আমরা কেন ভয় পাবো?”
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া গোলাপ বানু বলেন, “আমার অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নাই। কিন্তু আমার মেমোরি ভালো। আমি চেয়েছি, নারীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার শিক্ষা আমার নেই- আপনারাই তা প্রকাশ করে দেবেন।
“আমরা নারী ও শিশুদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই। আমরা নারী ও পুরুষরা একসাথে কাজ চালিয়ে গেলে এগিয়ে যাবই।”
রোকেয়া পদক নিজের মা এবং বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন মমতাজ বেগম ।
‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যা করিতে হয় তাহাই করিব। প্রয়োজন হলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি জজ সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পর ভাইসরয় হয়ে এদেশের সমস্ত নারীকে রাণী করিয়া ফেলিব’ বেগম রোকেয়ার এই কথাগুলো উদ্ধৃত করে মমতাজ বেগম বলেন, “আমরা এখন রাণী হয়েছি। নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী স্পিকার, এখন আমরা রাণী।”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করে বলেন, “তিনি অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন বলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
“তিনি যদি না থাকতেন, আমাদের শিক্ষার পথ না দেখালে- আমরা এতোদূর এগিয়ে যেতে পারতাম না।”
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই অঞ্চলে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের অবস্থার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সে সমাজে মেয়েদের নিচু চোখে দেখা হত। সেখানে তিনি (বেগম রোকেয়া) বিপ্লব করেছেন।
“আমাদের মুসলিম মেয়েদের অনেক বাঁধা ছিল।”
নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, “সমাজের নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা একান্ত প্রয়োজন। সমাজের অর্ধেক শিক্ষিত না হলে, সমাজ এগোবে না।”
বেগম রোকেয়া তার মতিচুর গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজেরই অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।’
রোকেয়ার এই লাইনগুলো উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি নারীস্থানের স্বপ্ন দেখতেন। আমরা তার নারীস্থানের স্বপ্ন অনৈকাংশে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।”
প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকারের পাশাপাশি বিচারপতি থেকে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং সশস্ত্র বাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
“আমরা চাই, প্রত্যেকটা নারী সমান সুযোগ পাবে,” বলেন তিনি।
অবহেলিত নারী সমাজকে অশিক্ষার অভিশাপ হতে মুক্ত করতে বেগম রোকেয়ার ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ওনার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি মেয়েদের শিক্ষার কথা বলতেন।”
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে সচিব তারিক-উল-ইসলাম স্বাগত বক্তব্য দেন।