ঢাকাবুধবার , ১০ ডিসেম্বর ২০১৪
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. কৃষি ও অন্যান্য
  5. খেলাধুলা
  6. গল্প ও কবিতা
  7. জাতীয়
  8. তথ্যপ্রযুক্তি
  9. দেশজুড়ে
  10. ধর্ম ও জীবন
  11. প্রবাস
  12. বানিজ্য
  13. বিনোদন
  14. বিশেষ প্রতিবেদন
  15. মুক্তমত
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পবায় মৎস্যচাষে বিপ্লব
এক বছরেই ৭ কেজি!

দৈনিক পাঞ্জেরী
ডিসেম্বর ১০, ২০১৪ ১:২৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

rajshahi-fish
রাজশাহী প্রতিনিধি : পুকুরের মাছ এক বছরেই বড় করা হয় ৬ থেকে ৭ কেজি। ১৫ থেকে ১৬ মাসের মধ্যে ৮ থেকে ১০ কেজি। অল্প সময়ের মধ্যে মাছ এতো বড় করার পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে ‘কার্প ফ্যাটেনিং’। এতে চাষিরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। অল্প সময়ের মধ্যে এ পদ্ধতি রাজশাহীর মাছ চাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শুধু তাই না রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফরমালিন মুক্ত জীবন্ত মাছ পৌঁছে দিতে বিশেষ ভুমিকা রাখছে রাজশাহী পবা উপজেলার পারিলা এলাকার চাষিরা।
মাছ চাষে বাংলাদেশ অনেকখানি সামনে এগিয়ে গেছে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এর ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান দখল করেছে।
তবে, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করতে গিয়ে দেশের বেশির ভাগ জায়গা থেকে বড় কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হারিয়ে গেছে বললেই চলে। চাষিরা সাধারণত এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত বড় করেই মাছ বাজারে ছেড়ে দেয়। বছরে দুই থেকে তিন বার উৎপাদনে যাওয়ার জন্য চাষিরা এ কাজ করে থাকে।
উৎপাদন না থাকার কারণে বাজারে বড় মাছের চাহিদা এখন আকাশচুম্বী। সেই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার পারিলা এলাকার চাষিরা ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করে। বর্তমানে ওই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন করে মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি মাছ ৬ থেকে ৭ কেজি পর্যন্ত বড় করছে পারিলা অঞ্চলের মাছ চাষিরা।
পারিলা এলাকায় ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা  কয়েকজন চাষি জানান, বাজারে ছোট ও মাঝারি ধরনের মাছের আমদানি অনেক। সে কারনে মাছচাষিরা অনেক সময় দাম পায় না। তবে বড় মাছের চাহিদার তুলনায় আমদানি থাকে অনেক কম। বাজারে কোন বড় মাছ আসলে ক্রেতারা চড়া দাম দিয়ে কিনতে চায়। বড় মাছের এ চাহিদা থেকেই তারা ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছের চাষ শুরু করে। এতে করে তারা আগের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যে বাজারে মাছ বিক্রি করতে পারছে।
এ পদ্ধতিতে পুকুরে বছর শেষে প্রতি বিঘায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কেজি মাছের উৎপাদন পাওয়া যায়। বড় মাছ হওয়ার কারণে এসব মাছ প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এতে বিঘা প্রতি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার পর্যন্ত মাছ বিক্রি করা সম্ভব।
মাছচাষিরা জানান, মাছ ছোট উৎপাদন করে প্রতি বিঘা থেকে বছর থেকে এক লাখ ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করা যেতো। তবে ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করে এক দুই থেকে তিন গুণ বেশি মাছের চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
পারিলা এলাকার মিজানুর রহমান। দীর্ঘ দিন ধরে মাছের চাষ করছেন। ২০ হাজার টাকা পূঁজি নিয়ে মাছ চাষে নানা মিজানুর রহমানের মূলধন এখন কোটি টাকার ওপরে। আর্থিক উন্নতির বিষয়ে বলতে গিয়ে মাছ চাষি মিজানুর রহমান জানান, ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ চাষের পর থেকে তার লাভের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়েছে। বর্তমানে তিনি ৩৩ একর (১০০ বিঘা) জমিতে মাছ চাষ করছেন।
একই এলাকার সোহরাব হোসেন, শরিফুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, আগে মাছ অল্প বড় করে বাজারে ছেড়ে দেয়া হতো। এতে মাছ চাষে তেমন লাভই হতো না। তবে, ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার পরে তাদের ভাগ্য পাল্টেছে।
বড় মাছ উৎপাদনের জন্য দুইটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেন মাছ চাষিরা। এদের একটি হলো মাছ তরতাজা অবস্থায় বাজারজাতকরণ ও অপরটি মাছের ভালো মানের খাবার। দুই সমস্যার একটি (বাজারজাতকরণ) চাষিরা নিজেদের পদ্ধতিতে সমাধান করে ফেলেছেন। চাষিদের নিজস্ব পদ্ধতিতে পুকুর থেকে মাছ তুলে শুধু তরতাজা নয় একবারে জীবন্ত মাছই পৌঁছে দিচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক বাজারে।
এ পদ্ধতিতে চাষিরা ট্রাকে মোটা পলিথিন বিছিয়ে দেয়। এরপরে সেখানে পানি দেয়া হয়। ওই পানিতে পুকুর থেকে মাছ তুলে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপরে ট্রাকে করে মাছ নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়। ট্রাকের পানিতে আঘাত করে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে একজন শ্রমিক থাকে। প্রতি ট্রাকে এ পদ্ধতিতে ১৪ থেকে ১৫ মণ মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। বর্তমানে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার মাছের বাজারে যে বড় জীবন্ত মাছ পাওয়া যায় তার বেশিরভাগটাই পবার পারিলা এলাকার। প্রতিদিনই এখান থেকে মাছের ট্রাক ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় যায়। এখন ঢাকা নিউমার্কেটে এধরনের বড় মাছ ‘পারিলার মাছ’ বলেই পরিচিতি লাভ করেছে।
তবে মাছ নিয়ে যাওয়ার পথে নানান ভাবে মাছচাষিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চাষিদের কয়েকজন জানান, রাজশাহী থেকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার সময় পথে পথে পুলিশি চাঁদাবাজি অন্যতম। এ চাঁদাবাজির কারণে চাষিদের ঢাকা মাছ নিয়ে যেতে অতিরিক্ত ৬ থকে ৮ হাজার টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে।
মাছের বাজারজাতকরণের সমস্যা মাছচাষিরা নিজেরা সমাধান করলেও এতো বড় জীবন্ত মাছে বিক্রির ভালোমানের বাজারের সঙ্কট আছে বলে মাছ চাষিদের অনেকেই জানিয়েছেন। যে পরিমাণে মাছ বর্তমানে পারিলা এলাকা থেকে ঢাকায় যায় তার নিউমার্কেট, যাত্রাবাড়ি ও গাজীপুরের কালিয়াকৈইরের মতো হাতেগোনা কয়েকটি বাজার অপ্রতুল। এ ধারনের মাছ বিক্রি করতে আরো বড় ও জীবন্ত মাছের অ্যাকুরিয়ামসহ বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠা জরুরি বলে মনে করেন চাষিরা। সেই সঙ্গে মাছগুলো যে শতভাগ ফরমালিন মুক্ত তা ক্রেতাদের জানাতে আরো প্রচারণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
মাছের ভালোমানের খাদ্য একটি বড় সমস্যা। মাছচাষিদের অভিযোগ, বাজারে যেসব মাছের খাবার পাওয়া যায় সেগুলো গুনে ও মানে ততোটা ভালো না। পুকুরের এসব খাদ্য প্রয়োগ করে চাষিরা তেমন কোনো লাভ করতে পারছে না। এছাড়াও মাছের খাদ্যের দামও অনেক বেশি।
চাষিদের এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে, আমেরিকান কৃষি বিভাগের সহায়তায় সিফ বাংলাদেশ এগ্রিভেঞ্চার লিমিটেড। কোম্পানিটি রাজশাহী জেলার মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। শুধু তাই না, মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে এ ধরনের সমস্যার কথা শুনে মাছের খাদ্যগুন নিশ্চিত করতে সম্প্রতি আমেরিকান কৃষি বিভাগের সহায়তায় ‘বাংলা ফিড মিল’ নামে পবায় হরিয়ানে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যেই ফ্যাক্টরি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
মৎস্য উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে সিফ বাংলাদেশ রাজশাহীর কোঅর্ডিনেটর আসাদুল্লাহ গালিব জানান, উওরাঞ্চলে মাছের বিপ্লব ঘটাতে মূলত তাদের এ কার্যক্রম। এতে তাদের কোম্পানিটি মাছ চাষিদের মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ ও চাষিদের দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করে আসছে। ‘বাংলা ফিস ফিড’ নামে ফ্যাক্টরি থেকে গুনগত মানের মাছের খাদ্য অল্প দামে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করতে পারবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. দেলোয়ার হোসেন জানান, পবা উপজেলার পারিলা এলাকার কিছু মাছ চাষি এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছে। এটা অত্যন্ত লাভজনক একটি পদ্ধতি। কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। তবে পারিলা এলাকার চাষিরা এটাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন। তিনি সিফ নামের প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে মাছ চাষিদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে চাষিরা অনেক লাভবান হচ্ছে। সেই সঙ্গে চাষিদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন আরো জানান, ওই এলাকার চাষিরা নিজেদের উদ্ভাবিত বাজারজাতকরণ পদ্ধতির মাধ্যেমে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে ফরমালিনমুক্ত জীবন্ত মাছ সরবরাহ করে আসছে। এতে চাষিদের যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যায় তাহলে দেশের বিভিন্ন বাজারে ফরমালিনমুক্ত মাছ সরবরাহ অনেকাংশেই বাড়বে।
কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পুকুরে মাছ পাতলা করে চাষ করা হয়। সাধারণ পদ্ধতিতে বেশি মাছ পুকুরে ছেড়ে সামান্য বড় হতেই বাজারজাত করা হয়। কিন্তু ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছ পুকুরে পাতলা করে চাষ করা হয়।
এ পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ১৫০ থেকে ২০০টি রুই, সিলভার কার্প ও কাতলা ৫০টি করে, মিরর কার্প ২৫ থেকে ৩০টি, মৃগেল ১৫০টি ও গ্রাস কার্প ৫টি করে চাষ করা হয়। পুকুরে সাধারণত যে পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হয় তাতে প্রতি বিঘায় এ সংখ্যার তুলনায় ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি মাছ চাষ করা হয়।
‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে মাছের পোনা নির্ধারণ করাই মুখ্য বিষয়। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে হলে পোনাকে অধিক সংখ্যক (চাপে) একটি পুকুরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। অতি চাপে মাছের পোনা একটি পুকুরে ৭ থেকে ৮ মাস রাখা হয়। এরপরে পোনাগুলো ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজন হলে ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সংখ্যায় মাছ অন্য পুকুরে ছাড়া হয়। অল্প মাছের জন্য বেশি করে সুষম খাবার দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতেই এক বছরেই মাছ ৮ কেজি থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তবে বর্তমান সময়ে এ পদ্ধতিতে নতুন কোনো প্রক্রিয়া যোগ করেছে এখানকার চাষিরা। ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ পদ্ধতিতে কার্প জাতীয় মাছের সঙ্গে মনোসেক্স জাতীয় তেলাপিয়া মাছ চাষ করা হয়। এ ‘কার্প ফ্যাটেনিং’ এর নতুন একটি পদ্ধতি। আমেরিকান কৃষি বিভাগের সহায়তায় সিফ বাংলাদেশ এগ্রিভেঞ্চার লিমিটেড কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে কয়েকমাস এ অঞ্চলের চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়। এরপরই চাষিরা পুকুরে কার্প মাছের সঙ্গে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে দক্ষ হয়ে উঠে। এতে কার্প জাতীয় মাছের পাশাপাশি বিঘায় ২ হাজার টি মনোসেক্স তেলাপিয়া পুকুরে চাষ করা হয়। অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে এ তেলাপিয়া মাছ একেকটি বছর শেষে এক কেজি ওজনের হয়ে থাকে।