নিজস্ব প্রতিবেদক : নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একেরপর এক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( শেকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক শাদাত উল্লা। পদ খালি না সত্ত্বেও নিজের ক্ষমতায় পদ সৃষ্টি করেছেন। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সেসব পদে নিয়োগ দিয়েছেন নিকটাত্মীয়দেরকে। এর বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, এ বাণিজ্যের জন্যই নিয়োগের শর্ত শিথিল করেছেন তিনি। যারা গত বছর অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এবার নিয়োগ পেয়েছেন। টাকা কামানোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোই রাখতে এই মিশনে নেমেছেন তিনি।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে ১০ জনকে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২৯ জনকে। পদ শূন্য না থাকা সত্ত্বেও কৃষি বনায়ন বিভাগে ৪ জন, কৃষি প্রাণরসায়ন বিভাগে ৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও কৃষি রোগতত্ত্ব বিভাগে এক জনের পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২ জনকে। এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের একটি পদে ৩ জন, কোলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে একটি পদে ২ জন এবং কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে দুটি পদে ৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে নিকটাত্মীয়দের নিয়োগ দেয়ার জন্য নিয়োগের নীতিমালারও পরিবর্তন করেছেন উপাচার্য। এসএসসি ও এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়া গত বছরে যারা অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন তাদের চাকরি দেয়ার জন্য এ বছর নীতিমালা পরির্বতন করে রেজাল্টের শর্ত কমিয়ে আনা হয়।
অন্যদিকে আবেদন বেশি হওয়ার কারণেই পদের তুলনায় বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন। তারা বলছে, বেশি আবেদন পত্র জমা পড়েছিল, পাশাপাশি পোস্টও খালি ছিল, তাই ওইসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ বেশিরভাগই পদের অতিরিক্ত নিয়োগ।
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকই অভিযোগ করে বলেছেন, এ উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে মেধার মূল্যায়ন হবে না। তাই তারা এ উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছেন। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষকদের একটি অংশও এ ভিসির পদত্যাগ দাবি করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এর আগে যারা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদরে মধ্যে এই ভিসি দুর্নীতিতে সবার শীর্ষে। তিনি তার এ অনিয়ম ও দুর্নীতি অব্যাহত রাখলে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয়ের লেখা পড়ার মান যেমন নষ্ট হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্য হারাবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে তাকে স্নাতকে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩.৫ (৪ পয়েন্ট ভিত্তিক) এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ন্যূনতম জিপিএ ৪ ( ৫ পয়েন্ট ভিত্তিক) পেতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৩ ( ৫ পয়েন্ট ভিত্তিক) করা হয়। যা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগে নীতিমালায় এমনটা দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যলয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘ক্ষমতাশীল দলের প্রভাবশালী শিক্ষক ও কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের ভাতিজি সালমা আক্তার উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৩.৫ এর থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানানোর জন্য তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞপ্তিতে পরিবর্তন আনা হয়। জিপিএ ৩ পয়েন্ট করা হয়।’
অপর এক শিক্ষক বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ভাতিজি সালমা আক্তারকে নিজ বিভাগে নিয়োগের জন্য নিজেই ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে উপাচার্য প্রফেসর মো. শাদাত উল্লাও নিজের ভাতিজির নিয়োগের জন্য ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। যা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগের নিয়োগআইন পরিপন্থি।’
এছাড়াও শাদাত উল্লা তার ছেলে ওয়াসেল-বিন-সাদাতকে কৃষি অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন। এ কারণে তিনি নতুন একটা পদও সৃষ্টি করেছেন যাতে ছেলেকে নিয়োগ দেয়া যায়।
উপাচার্যের ছেলে প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘ভিসির ছেলে ইউকের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে যা নীতিমালার পরিপন্থী। তার ছেলে গত বছর দেশে সে মদ্যপ অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।’
শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াও ভিসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সেকশন অফিসার পদে ২ জনকে নিয়োগ দেয়ার অনুমতি দিলেও নিয়োগ দেয়া হয় ২৪ জনকে। এছাড়াও কর্মচারী ৭ জনকে নিয়োগ দেয়ার অনুমতি থাকলেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২২ জনকে।
এর আগে ২০১৩ সালে নিয়োগে উপাচার্য মো. শাদাত উল্লা তার নিজের শ্যালক চৌধুরী মো. সাইফুল ইসলামকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, আত্মীয় ড. মো. আনুয়ারুল ইসলামকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সে সময়ও তিনি প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছিলেন। চৌধুরী মো. সাইফুল ইসলাম তার অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেটও জালিয়াতি করেছিলেন। নিয়োগের সময় ১৫ বছর ৩ মাস ২৬ দিন অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করলেও তার অভিজ্ঞতা মাত্র এক বছর। তিনি তিনি গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে ছয় মাস এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের পদেও রয়েছে জালিয়াতির অভিযোগ। ড. মো. আনুয়ারুল ইসলাম রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত থাকলেও একই সঙ্গে তিনি লাইব্রেরিয়ান পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেও তাকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এটাও নিয়োগ নীতিমালার পরিপন্থি।
উপাচার্যের ভাতিজি শারাবান তাহুরাকেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সার্টিফিকেট দিয়ে ৩১ বছর বয়সে নিয়োগ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটি আদৌও সঠিক ছিল কি না যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে। এ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তার মোবাইল বিল এসেছে ৩৮ হাজার টাকা! এছাড়া জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভিসির অফিসের কাচ্চি বিরিয়ানী খরচ ৪৭ হাজার টাকা।
এই ভিসির দায়িত্ব গ্রহণ থেকে প্রতি বছরই বিবিধ খরচ বাজেট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে ২০১২-১৩ সালে তার খরচের জন্যে বাজেট ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা থাকলেও খরচ দেখানো হয় ৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা। পরবর্তী বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বাজেটের জায়গায় খরচ দেখানো হয় ৬ লাখ টাকা, ১৪-১৫ সালে ৬ লাখ টাকার বাজেটের জায়গায় খরচ দেখানো হয় ১২ লাখ টাকা।
কিছুদিন আগে ভিসির বাসার আসবাবপত্র মেরামতের জন্যে ৬ লাখ টাকা তোলা হয় যদিও একসাথে ৫০ হাজার টাকার বেশি তোলার কোনো নিয়ম নেই।
ভিসি তার দায়িত্ব গ্রহণের দেড় বছরে নিজের খরচের জন্যে ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা তুলেছেন। যার অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. মো. হযরত আলী, যার বিনিময়ে ভিসি তার পছন্দের লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়ে দিচ্ছেন।
এদিকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
ইতোমধ্যে অধ্যাপক ড.মোহাম্মাদ মোহাব্বত খানকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিক্ষামন্ত্রণায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে ইউজিসি জানিয়েছে।