নিজস্ব প্রতিবেদক : তিনি এলজিইডি’র সহকারী প্রকৌশলী। কিন্তু তার কথায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলীও বদলি হয়ে যান। এছাড়া কর্মচারি পর্যায়েও তার ইশারায় বদলী হয়ে থাকে। তাকে খুশি করতে না পারলে ভালো কোনো প্রকল্পের পরিচালক হওয়া যায় না। সারাদেশের ৬৪ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা তার ভয়ে তটস্থ থাকেন। তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেন স্বয়ং প্রধান প্রকৌশলী। ক্ষমতাধর এ কর্মকর্তার নাম জহুরুল আলম মণ্ডল ওরফে ভেলু। অস্ট্রেলিয়াতে তার বিলাসবহুল বাড়িও আছে। কিসে তিনি খুশি আর কিসেই বা নারাজ হন- সেই আতঙ্কে এলজিইডি’র কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দিন কাটে। কিন্তু এভাবে তো আর একটি সরকারি অফিস চলতে পারে না। প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করতে গেলে চাকরি হারানোর ভয়ও রয়েছে। এ জন্য বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা দিন দিন সোচ্চার হয়ে উঠছেন। জহুরুল আলম মন্ডলের দুর্নীতি-অপকর্মের সিরিস্তি তুলে ধরে সারাদেশে লিফলেট বিতরণ শুরু হয়েছে। একজন ভুক্তভোগি বলেন, প্রশাসনিকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না- এটা আমরা জানি। সে কারণেই সারাদেশের মানুষকে তার দুর্নীতির ফিরিস্তি জানানোর জন্য লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, এলজিইডি’র ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে জহুরুল আলম মণ্ডল ক্রমেই ক্ষমতাধর হয়ে উঠছেন। প্রধান প্রকৌশলী তার মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করায় তিনি সেই সুযোগে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপরও ছড়ি ঘুরাতে শুরু করেন তিনি। ভুক্তভোগীরা জানান, এর আগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) শহিদুর রহমান প্রামাণিকের সাথে বিরোধের জের ধরে ক্ষমতাধর এই সহকারী প্রকৌশলী জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু) শহিদুর রহমান প্রামাণিককে প্রশাসন থেকে সরিয়ে দেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হবে তাও তিনি নির্ধারণ করেন। বিনিময়ে তিনি নেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। ঢাকার বাইরের জেলা শহরের নির্বাহী প্রকৌশলীরাও তাকে খুশি না রেখে কোনো কাজ করতে পারেন না। মণ্ডলকে খুশি করতে না পারলে বদলি নিশ্চিত- এমন কথা সারাদেশেই প্রচলিত হয়ে গেছে। আর কেউ প্রধান কার্যালয় থেকে জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যেতে চাইলে জহুরুল আলম মণ্ডলকে ঘুষ দিলেই তা হয়ে যায়। এমনিভাবে একজন সহকারী প্রকৌশলী হয়েও তিনি পুরো এলজিইডিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছেন। বিনিময়ে গত ৭ বছরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই সহকারী প্রকৌশলী এলজিইডি’র প্রকল্প পরিচালকদের নামে বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল দামি পাজেরো জীপ ব্যবহার করেন। যেন তিনিই সর্বেসর্বা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রধান প্রকৌশলীর পরামর্শে অস্ট্রেলিয়াতে একটি বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন জহুরুল মণ্ডল। ওখানে প্রধান প্রকৌশলী আগেই বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে কখনো ধরা পড়লে পালিয়ে গিয়ে যাতে সেখানে বসবাস করতে পারেন- সে ব্যবস্থা আগে ভাগে পাকাপোক্ত করে রেখেছেন। যদিও দুদক এরই মধ্যে প্রধান প্রকৌশলীসহ জহুরুল আলম মন্ডলের সম্পদের তদন্তও করছে।
কে এই জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু)?
সহকারী প্রকৌশলী জহুরুল আলম মন্ডলের (ভেলু) গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার সাঘাটা ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত হাচেন আলী মণ্ডল। তারা ৫ ভাই, দুই বোন। ভাই বদরুল আলম মণ্ডল পেশায় একজন ডাক্তার, এক ভাই শহিদুল ইসলাম ওরফে নান্নু মাস্টার। কচুয়া গ্রামের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক পাঞ্জেরীকে বলেন, জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু) ও তার ভাই ডা. বদরুল আলম সাঘাটা ইউনিয়নে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তার ভাগ্নি জামাই ফরহাদ হোসেনকে গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করেও তাকে চেয়ারম্যান বানাতে পারেননি। কারণ ইউনিয়নবাসীর কাছে জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু) একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। আর এ কারণে সাঘাটা ইউনিয়নবাসী তাদেরকে প্রত্যাখান করে। সূত্র আরো জানায়, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার ভাগ্নি জামাই ফরহাদ হোসেনের পক্ষে টাকার বস্তা নিয়ে জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু) ও তার ভাই ডা. বদরুল ভোট কিনতে সাঘাটা ইউনিয়নের বাসহাটা গ্রামে গেলে তার প্রতিপক্ষরা গণধোলাই দিয়ে টাকার বস্তাসহ আটকে রাখে। পরে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এলাকাবাসী আরো জানান, তার বাবা একজন কৃষক হলেও তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার ছেলে জহুরুল আলম মণ্ডল (ভেলু) সামান্য বেতনভুক্ত একজন প্রকৌশলী হয়েও কিভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তার হিসেব নিকাষ মিলাতে পারছেন না এলাকাবাসী। গাইবান্ধা এলাকার একজন প্রকৌশলী জানান, অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা জহুরুল আলম মণ্ডল রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় তার এলাকার মানুষেরাও হতবাক। তারা বুঝতেই পারেন না সরকারি চাকরি করে কিভাবে রাতারাতি এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া যায়।
শুধু জহুরুল আলম মণ্ডলই নয় পিডি মোস্তফা কামাল, পিডি খুরশিদ হাসান, সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (প্রশাসন) রেজাউল করিম, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক জাহিদুর রহমান খান, প্রকল্প পরিচালক আতাউর রহমান ও প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম আখন্দ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে ধরা পড়ার আশঙ্কায় তারা মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোমের সুযোগ নিয়ে প্রত্যেকেই বাড়ি বানিয়েছেন বলে সূত্র জানায়। এদের বিরুদ্ধে এলজিইডিতে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের চেইন অব কমান্ড বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন খোদ এলজিইডির কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। এদের বেপরোয়া ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ সোচ্চার হতে শুরু করেছে। এ ভয়েই তারা নিরাপদ স্থান হিসেবে দেশের বাইরে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর ব্যবস্থা আগে ভাগেই করে রেখেছেন। এলজিইডি’র চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ জহুরুল আলম মণ্ডলসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেরাদের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিজ্ঞ মহল সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জহুরুল আলম মণ্ডলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।