ঢাকা: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান এ কে খন্দকার যে কথা বলেছেন সেটিই সত্য। জনগণ সেটি বিশ্বাস করে। আর এতে আওয়ামী লীগের গায়ে জ্বালাপোড়া করছে।’
তিনি বলেন, ‘তার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে এতোদিন ধরে আওয়ামী লীগ যে মিথ্যাচার করে আসছে তা বেরিয়ে এসেছে। এজন্যই এখন তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বিচার করার কথা বলা হচ্ছে।’
শুক্রবার নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় অফিসে দলের সাবেক নেতা এম সাইফুর রহমানের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে যোগ দিয়ে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন।
ফখরুল বলেন, ‘আমরা যারা ৭ মার্চের ভাষণ সেখানে উপস্থিত থেকে শুনেছি তারা জানি বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে। তখনকার বাস্তবতায় এটি ঠিক ছিল। এটা বললে কাউকে খাটো করা হয় না, কেউ খাটো হন না।’
‘কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, তারা সবাই কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিল সেহেতু ইতিহাসের এ সত্য তারা মেনে নিতে চায় না’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, নবম সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত সংসদ সদস্য ও তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইটির কিছু অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বইটির কোনো কোনো অংশ উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিচ্ছেন।
বইটিতে একে খন্দকার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন।’
‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন’- বইটিতে লেখা এ অংশটি নিয়ে বৃহস্পতিবার দশম সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে আলোচনার সূত্রপাত হয়।
এরপর পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে একে খন্দকারের ব্যাপক সমালোচনা করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা।
পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে জাসদের সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল বলেন, ‘একজন সামরিক নেতা কী করেছেন, না করেছেন সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই না। অতিরিক্ত বয়সে বাংলাদেশে এ সমস্যা হয়। আমি তাকে বলতেত চাই, ডোন্ট ক্রস কনস্টিটিউশন।’
কাটতি ‘বাড়ানোর’ জন্য বইয়ে ‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন’- এমন বক্তব্য লেখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন বাদল।
তিনি আরও বলেন, ‘গত সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন একে খন্দকার। মন্ত্রীত্ব থাকাকালীন কোনো ফোরামে এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্যই দেননি। তিনি এখন মন্ত্রী নেই, তাই এসব বলছেন।’
বাদল বলেন, ‘বাংলাদেশে উপকার করলে গালি খেতে হয়। আমাদের সংবিধান আছে। মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি তো এ শাসনতন্ত্র মেনেই চলেছেন। সেটাতে স্বাক্ষরও করেছেন। এখন এসব বলছেন। এসব লোকদের কী হবে। জাতির সামনে সে প্রশ্ন আনতে চাই।’
পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে একে খন্দকারের কড়া সমালোচনা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদও। তিনি বলেন, ‘তিনি কিছু দিন আগে আমাদের কেবিনেট সদস্য ছিলেন। গত সংসদে যখন মন্ত্রী ছিলাম না, তখন তিনি আমার পাশেই বসতেন।’
তোফায়েল বলেন, ‘ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কী হয়েছিল এদেশের মানুষ তা জানে। ওনার লেখার আর জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। বইটিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করা হয়েছে এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
‘ইয়াহিয়া খান দুর্গত এলাকায় যাননি, এটা তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’ বইয়ে উল্লেখিত এ কথার জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটা যদি ইয়াহিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয় তাহলে একাত্তরের গণহত্যা কি? তা কি একে খন্দকারের কাছে ভুল মনে হয় না?’
বইয়ে তথ্যের ভুল ধরে তোফায়েল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের ১৪ দিন পর ভোলায় গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি (একে খন্দকার) বলেছেন, এগুলো ঊনসত্তরের বিষয়ে, এ ব্যাপারে তিনি জানেন না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এসব কথা বলা মানে অন্যের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া। ওনার বয়স হয়েছে। ওনার সমালোচনা করতে চাই না। ওনাকে শেখ হাসিনা পরিকল্পনামন্ত্রী করেছিলেন। মানুষের মধ্যে কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে না?’
তোফায়েল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন, যিনি সব জানতেন। সেনানিবাসে কী প্রস্তুতি চলছিল, তাও তিনি জানতেন।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে কি হাওয়ার ওপর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনা ও কঠোর পরিশ্রমের ওপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে।’
আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রীর সমালোচনা করে তাকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে ‘কুলাঙ্গার’ পর্যন্ত বলেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ।
ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘একে খন্দকার একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একটা বিকৃত ইতিহাস রেখে গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। আমরা যেখানে যে অবস্থায় বা যে দলে থাকি, কিন্তু স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে কম্প্রোমাইজ করতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একে খন্দকার যে শব্দ এনেছেন, এ সংসদে সেটা তুলতে চাই না। এ সমস্ত কুলাঙ্গাররা গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।’
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও উপপ্রধান সেনাপতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে গঠিত সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন। অবসরগ্রহণের পর সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।