নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীতে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সর্বরাহ না থাকায় এমন সংকটে পড়তে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। শুষ্ক মৌসুমে ভূ-গর্ভে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও নদীতে দূষণের মাত্রা বেশি হওয়ায় পানি শোধনে বেশি সময় লাগছে। এ কারণেই পর্যাপ্ত পানি উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে চাহিদার চেয়েও অতিরিক্ত পানি উৎপাদন করছে তারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর বেশিরভাগ আবাসিক এলাকায় পানি সংকট রয়েছে। কর্মব্যস্ত মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতে গেলে পানি পান না। মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলেও তা আবার কিছুক্ষণ পর নেই। এর মধ্যেও রয়েছে ময়লা ও দুর্গন্ধ। নগরবাসীর অভিযোগ, তারা অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক এলাকায় রান্না, গোসল, কাপড় ধোয়া ও পান করার পানি পর্যন্ত নেই। ফলে রান্না-বান্না, অজু- গোসলসহ প্রাত্যহিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে পানি এনে সাংসারিক কাজ সারেন।
পানি সংকটের কারণে বাড়ির মালিকরা তাদের ভাড়াটিয়াদের নির্ধারিত সময় বেঁধে দিয়ে পানি সরবরাহ করছেন। কেউ কেউ রাত ১১টার পর থেকে সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত পানি দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ শুধু সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত দিচ্ছেন। আবার কিছু এলাকায় সন্ধ্যার পর পানি আসলে ভোরে চলে যায়। বাসায় পানি না পেয়ে অনেককে ব্যবহারের জন্য বাইর থেকে পানি কিনে নিতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, দয়াগঞ্জ, আরামবাগ, ফকিরেরপুল, মতিঝিল, মধুবাজার, রায়ের বাজার, শংকর, পান্থপথ, মগবাজার, নারিন্দা, চাঁদনীঘাট, তাঁতীবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, ফার্মগেট এলাকা, শান্তিনগর, বিজয়নগর, মালিবাগ, কমলাপুর, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, বাসাবো, কদমতলা, আহমেদবাগ, কুসুমবাগ, গোরান, মুগদা, ধোলাইখাল, মিটফোর্ড, বাবুবাজার, সিক্কাটুলী, ইসলামপুর, বংশাল, আরমানিটোলা, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, শাঁখারীবাজার, মানিকনগর, গোপীবাগ, জিয়ামাঠ, অভয়দাস লেন, কেএম দাস লেন, স্বামীবাগ, ওয়ারী, মৈশুটি, বনগ্রাম, নবাবপুর, মিরপুর-১০, ১১, ১২, কুড়িল-বাড্ডাসহ বেশ কিছু এলাকায় পানির অভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন।
ওয়াসার সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকায় ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দৈনিক পানির চাহিদা ছিল ২৫০ কোটি লিটার। কিন্তু সে সময় সরবরাহ করা হতো ২শ কোটি লিটার। তখন ৫০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি ছিলো।
তবে ওয়াসা জানায়, বর্তমানে ঢাকাবাসীর দৈনিক ২২০ কোটি লিটার পানির চাহিদার রয়েছে। এর বিপরীতে তারা উৎপাদন করছে প্রায় ২৪২ কোটি লিটার। ফলে উদ্বৃত্ত থাকছে ২২ কোটি লিটার। তাহলে এই উদ্বৃত্ত পানি কোথায় যাচ্ছে? এর কোনো সঠিক উত্তর নেই ওয়াসার কাছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বুড়িগঙ্গার পানিতে ব্যাপক পরিমাণে ময়লা ও বর্জ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সঙ্কট। এ কারণে শোধনাগারগুলোতে পানি শোধনে অতিরিক্ত সময় লাগছে। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ পাম্পে পানির চাপ কমে গেছে। সে জন্যই মূলত পানির এমন সঙ্কট।
ওয়াসা জানায়, রাজধানীতে সরবরাহ করা পানির ৮৬ শতাংশই আসে ভূ-গর্ভ থেকে। বাকি ১৪ শতাংশ পানি নদী থেকে শোধন করে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু নদীগুলোর পানি দূষিত হওয়ায় শোধনাগারের উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছর তিন মিটার হারে পানির স্তর নিচে নামছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে রাজধানী ঢাকায় আড়াই মিটার হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানীতে ঢাকার ওয়াসার ৬৭৭টি পাম্প রয়েছে। এগুলো সচল রাখতে চারশতাধিকেরও বেশি জেনারেটর রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এর উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়ার দরকার বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, পানির সংকট নিরসনে ঢাকা ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে অভিযোগ জানাতে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর ফকিরেরপুরের বাসিন্দা জাফর উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৯টার আগেই অফিসে যেতে হয়। কিন্তু এসময় বাসায় পানি থাকে না। ফলে খাওয়া দাওয়া ও গোসল ছাড়াই অফিসে যেতে হয়। এর পর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে মাঝে মধ্যে পানি পাওয়া যায়। কিন্তু পানির মধ্যে গন্ধ।
মিরপুর পল্লবীর বাসিন্দা তানভীর বলেন, ‘গারম কালের মতো শীতকালেও পানি নিয়ে বিপদে আছি। গোটা দিনের মধ্যে রাতে একটু পানি পাওয়া যায়। তা আবার গাসল সারতে সারতেই শেষ হয়ে যায়। রাস্তা-বান্না করতে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি জানান, পানি সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বড় একটি ড্রাম ক্রয় করেছেন। কিন্তু এতেও হচ্ছে না।
তবে নগরবাসীর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসীম এ খান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা এখন রাজধানীর দৈনিক চাহিদার অতিরিক্ত পানি উৎপাদন করে। কেউ যদি বলে তারা পানি পায় না এটা বিশ্বাস যোগ্য নয়। তবে কোথাও পানির সার্ভিস লাইনে ছিদ্র বা ত্রুটি দেখা দিলে তা দ্রুত মেরামত করা হয়।’