গাজীপুর প্রতিনিধি : টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের তীরে আগামী ৯ জানুয়ারি থেকে দুই পর্বে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা।
বাঁশের খুঁটি ও আড় সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল প্যান্ডেল। দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। ইজতেমা সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য গত রোববার দুপুরে প্রস্তুতিমূলক সভা গাজীপুর জেলা প্রশাসকের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বি মাওলানা গিয়াস উদ্দিন জানান, বিশ্ব ইজতেমা সফল ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন ও দ্বীনের মেহনত কায়েমের লক্ষ্যে জোড় ইজতেমা থেকেই মুসল্লিরা দলে দলে ভাগ হয়ে ইজতেমার মাঠে কাজ করছেন। এরই মধ্যে ময়দানের ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাঠে আসতে শুরু করেছেন দেশ-বিদেশের মুসল্লিরা।ইজতেমা-estema-01 ৯ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা
তিনি জানান, কিছু অংশ দখল হওয়ায় ওই অংশ দিয়ে দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের মুসুল্লিদের ইজতেমা ময়দানে যাতায়তসহ ইজতেমার কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। এছাড়া মুসুল্লিদের তুরাগ নদী পারাপারের জন্য নদীতে পল্টুন ব্রিজ তৈরি করার মালামাল ও সরঞ্জাম নিয়ে সেনাবাহিনীর যানবাহন পার্কিং ও কাজকর্ম করার জায়গারও সংকট দেখা দেবে।
ময়দানের বিস্তৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯৬ টঙ্গীতে ১৬১ একর জমি ইজতেমা ময়দানের ব্যবহারের জন্য রাজউকের সঙ্গে সরকারি চুক্তি হয়। ১০ থেকে ১৫ বছর পর ওই জায়গায়ও মুসল্লিদের সঙ্কুলান হচ্ছিল না। ফলে ইজতেমার সময় ময়দানের আশে-পাশের খোলা জমিতেও মুসল্লিদের অবস্থান নিতে হয়। এ ব্যাপারে সরকারকে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি। পরে অন্যত্র জমি দেয়ার শর্তে নদীর পশ্চিম তীরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেয়া জমির বরাদ্দ বাতিল করে দেয় রাজউক কর্তৃপক্ষ। পরে ওইসব জমি ইজতেমা ময়দানের সঙ্গে একীভূত করে মাঠ হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয় রাজউক।
এছাড়া আশুলিয়ার বেড়িবাঁধের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু জমি ২০০৮ সালে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ইজতেমা মাঠের জন্য ব্যবহার করার অনুমতি দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে ওইসব এলাকায় এক শ্রেণীর দখলদাররা মাছ ও কাঁচামালের আড়ত, বালির আড়তসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি রেখেছে। নদীর পশ্চিম তীরে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) নামে ১১ জমির বরাদ্দ বাতিল করে তার পরিবর্তে পূর্বাচলে রাজউক ১৫ বিঘার প্লট বরাদ্দ দিলেও তারা ইজতেমা মাঠের জন্য ওই জমি ছাড়ছে না।
একইভাবে স্থানীয় আইইউবিএটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইজতেমা ময়দানের মাঠ ব্যবহারে জন্যে রাজউকের দেয়া জমি দখলের অভিযোগে আদালতে মামলা চলছে। ফলে পশ্চিম পাশ দিয়ে ইজতেমা মাঠে মুসল্লিদের প্রবেশ ও যানবাহন পার্কিংয়ের স্থান সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা করছেন ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়ভাবে বিকল্প হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ দু’দফায় ইজতেমার আয়োজন করলেও ক্রমাগত মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইজতেমা মাঠে বর্তমানে তাদের স্থান সঙ্কুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তিনি ওইসব জমি দখলমুক্ত করে ইজতেমা ময়দানের ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। এমতাবস্থায় ময়দানের পর্ব পাশের বাটা, হোন্ডা ও টেশিস কারখানার অব্যবহৃত জমি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা ও অনুমতি কামনা করেন ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমা সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্নের লক্ষে গত রোববার দুপুরে প্রস্তুতিমূলক সভা গাজীপুর জেলা প্রশাসকের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রস্তুতিমূলক সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে ইজতেমা মাঠ প্রস্তুতিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ইজতেমা এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন, আইন-শৃঙ্খলা, বস্তি ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মুসল্লিদের অজু গোসল রান্না-বান্না খাবার পানি সরবরাহ, বিদেশি মেহমানদের জন্য টয়লেট ও গোসলখানা নির্মাণ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য সেবা, মশক নিধন ও দুর্গন্ধ দূরীকরণ, তুরাগ নদীতে পল্টুন ব্রিজ নির্মাণ, বিদেশি মেহমানদের তাবুতে গ্যাস সরবরাহ, টেলিফোন সংযোগ প্রদান, বিশেষ ট্রেন ও বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা, খাদ্যে ভেজাল রোধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসন, ইজতেমাস্থলে ধূলাবালি নিয়ন্ত্রণ ও মাঠ সমতরকরণ, পিএ কভারেজ, আপত্তিকর সিনেমা পোস্টার অপসারণ, ফুট ওভারব্রিজ সংস্কার, গাছপালা সংরক্ষণ, কন্ট্রোলরুম স্থাপন, ইজতেমা ছাড়া অন্যান্য মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ, হেলিপ্যাড নির্মাণ, ইজতেমা ময়দানে অস্থায়ী দোকানপাটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, বেতার, টিভি ও পত্রিকায় প্রচার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, আখেরি মোনাজাতের দিন যানজট, ভিআইপি টয়লেট নির্মাণ প্রভৃতি।
সভায় জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি ইজতেমার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বনিষ্ট হতে অনুরোধ করেন।
সভায় গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ পিপিএম, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মহসীন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসএম মোস্তফা কামাল ও ইজতেমার সংশ্লিষ্ট মুরুব্বিরা উপস্থিত ছিলেন।
ইজতেমার প্রস্তুতির ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম জানান, মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণজমায়েত বিশ্ব ইজতেমা আগামী ৯ জানুয়ারি শুরু হবে। ১১ তারিখে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ১৬ জানুয়ারি যা ১৮ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে। ইজতেমা সফল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ইজতেমাকে সফল ও সার্থক করার লক্ষ্যে সরকার থেকে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে এবং বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে অপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রোববার একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভায় গতবারের তুলনায় কীভাবে আরো সার্থকভাবে বিশ্ব ইজতেমা সফল করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বৃহত্তর স্বার্থে এবোলা ভাইরাস আক্রান্ত ৫টি দেশের মুসল্লিদের আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে, ইজতেমা সফল ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইজতেমা মাঠ পরিদর্শনসহ তাদের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছেন। প্রতিবারের মতো বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের প্রবেশ পথে তল্লাশির ব্যবস্থা ছাড়াও র্যাব ও পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, সিসিটিভি স্থাপন, খিত্তাওয়ারি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করবে। এবার ১৫ হাজার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশিদ।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইজতেমা মাঠ পরিদর্শন করেছে। যেহেতু এটা বিশ্বের বৃহত্তম জমায়েত তাই আমরা ইজতেমার আয়োজনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। ইজতেমা সফল করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু’টি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। ইজতেমায় উগ্রপন্থিদের তৎপরতা যদিও আশা করছি না তারপরও বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছি।