বিশেষ প্রতিবেদন : পাউবো’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্নীতি করলেও তা প্রতিরোধে কোন দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা যায় না। দুর্নীতি দমন কমিশনও এদের ব্যাপারে জোরালো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ফলশ্রুতিতে পাউবো’র চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনেকেই রয়েছেন বহাল তবিয়তে। কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তাদের সুবিধাজনক জায়গায় পোস্টিং নিয়ে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। পাউবো প্রশাসনের কাছে এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কদরও বেশি। এই কর্মকর্তারা মতিঝিলের ওয়াপদা ভবনে এলে তাদেরকে অনেকেই জামাই আদরে বরণ করে থাকেন। এই সমস্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দুদক-এর নজরে এলেও পাউবো তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ২০০৯ সাল থেকে ভোলা, পটুয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থ বছরে সিরাজগঞ্জ হার্ডপয়েন্ট শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয় যার ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৪৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক, উপসহকারী প্রকৌশলী শমসের আলী মন্টু, কে এম ফজলুল হক ও শাহ আলমকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে নামমাত্র বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও তাদের নিকট থেকে আত্মসাৎকৃত টাকা আদায়ে অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বরং নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মালেককে পরবর্তীতে বরগুনা পওর বিভাগের মতো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ভাল-মন্দ কাজ কতোটা করেছেন তা বারবার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন। সম্প্রতি ঐ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বিভাগের ছোট বালিয়াতলী ও ফেরী ঘাট রক্ষা প্রকল্প থেকে ১২ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল প্রদানের অভিযোগ রয়েছে জনৈক নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা। উক্ত প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী সফিউদ্দিন, উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াদুদ এবং উপসহকারী প্রকৌশলী মঈনুল ইসলামকে দায়ি করা হলেও তারা বর্তমানে বহাল তবিয়তে রয়েছে। অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সফিউদ্দিন বর্তমানে পটুয়াখালী পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্বে থাকলেও তাকে পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বও অর্পন করা হয়েছিল। গত কয়েক বছরে ঐ নির্বাহী প্রকৌশলীর নেতৃত্বে পটুয়াখালীতে সিরিজ দুর্নীতি হলেও তিনি রহস্যজনক কারণে কর্তৃপক্ষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন।
পর্যালোচনায় আরো জানা যায়, ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ অর্থ বছরে মেঘনা নদীর ভাঙ্গন থেকে চর ফ্যাশন ও মনপুরা শহর রক্ষা প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজে মোট ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি টাকা। এই প্রকল্প থেকে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ভোলার এই প্রকল্পের দুর্নীতির জন্যে নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম আতাউর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জামান খান, উপসহকারী প্রকৌশালী আবুল কালাম, নুর হোসেন, শাহ আলম ভূইয়া, আশরাফুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং শাহ মো. আমিনুল ইসলামকে দোষি সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পাউবো প্রশাসন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তিরস্কার বা গুরুদ-ের পরিবর্তে পুরস্কার প্রদান করে বলে প্রচারণা রয়েছে।
পর্যালোচনায় আরো দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ শহর রক্ষা প্রকল্পেও দৃশ্যমান দুর্নীতি হয়েছে। ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থ বছরে মোট ২১ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের দুইটি প্যাকেজে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই প্যাকেজ দু’টি থেকে ২.৫০ কোটি টাকার নয়ছয় করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এই দুর্নীতি তদন্তে প্রকৌশলী কামালুর রহমানকে প্রধান করে কমিটি গঠিত হলেও গঠিত তদন্ত কমিটির সাথে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা একাকার হয়ে যায়। এই কারণে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী শ্রীমান রমেশ চন্দ্র সেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু আজ অবধি এই ঘটনার কোন মীমাংসা হয়নি।
মোদ্দা কথা, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনায় একদল দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী প্রায় প্রতিটি প্রকেল্পেই দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় এবং পাউবো প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবেই এই সমস্ত জায়গায় দুর্নীতি ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। অপরদিকে, টাস্কফোর্সের সরেজমিন প্রতিবেদনের আলোকে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় টাস্কফোর্সের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন বলে টাস্কাফোর্সের একজন সদস্য জানিয়েছেন। ঐ সদস্য মনে করেন, টাস্কফোর্সের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। স্কচটেপ খুলে দিলেই আরো অনেক দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করা যাবে।
অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর পাউবো’র কর্মকর্তাদের প্রাপ্ত দুর্নীতির অনেক তথ্য এই প্রতিবেদকের নিকট রয়েছে যা যাচাই বাছাই স্বাপেক্ষে ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে। উপরোক্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাংক স্থিতি এবং বিত্ত বৈভবের বিস্তারিত বিবরণ যাচাই করা হচ্ছে। এই সমস্ত দুর্নীতি, অপকর্ম ও অনিয়ম এবং ঘটনার খলনায়কদের বিরুদ্ধে বিগত এপ্রিল মাসে টাস্কফোর্সের প্রধান কাজী তোফায়েল আহমদ একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে পাউবো’র নিকট জমা দেন। এই অভিযোগসমূহের অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরেও আনা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে সব অভিযোগই ফাইল চাপা অবস্থায় পড়ে আছে। পাউবো’র শৃংখলা শাখার একটি সূত্র জানায়, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অর্থের বিনিময়ে সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে পাউবো’র দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে কমিটি গঠিত হলেও অভিযুক্তরা সব সময় পার পেয়ে যায়। পুলিশ যেমন পুলিশের অপরাধের তদন্ত করলে তারা পুলিশের পক্ষাবলম্বন করে তেমনি পাউবো’র অধিকাংশ তদন্তকারী কর্মকর্তাই অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ হয়ে যান। তবে কিছু ব্যতিক্রমী কর্মকর্তাও আছেন যাদের কারণেই পাউবো এখনো টিকে আছে। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, পাউবো’র দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে পাউবো’র কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করা প্রয়োজন। এতে একদিকে যেমন তদন্তে স্বচ্ছতা বজায় থাকবে তেমনি পাউবো’র কর্মকর্তারা টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে পারবেন। এটা না করা হলে কোন কালেই দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করা যাবে না।
পাউবো’র দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি শুধুমাত্র পত্র-পত্রিকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। চলতি বছরের জুলাই মাসে পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ভোলার চরফ্যাশন গেলে সেখানকার টাউন হলে আয়োজিত এক কর্মী সভায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের বিচার দাবি করেন। এ সময় পানি সম্পদমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে সৎ ও স্পষ্টবাদী পানি সম্পদ মন্ত্রী বলেন, অবিলম্বে পাউবো’র অব্যবস্থাপনা বন্ধ করা হবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ দপ্তরের কাজে অনেক অস্বচ্ছতা, দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি ছিল যা বন্ধ করা হয়েছে। এখন থেকে আর বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধের কোন কাজ হবে না। বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধের কাজ হলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বেশি হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপরোক্ত বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ভোলার হতভাগ্য মানুষের সাথে দেশবাসীও আশ্বস্ত হয়। কিন্তু তারপরে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আদৌ কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে কি না তা অদ্যাবধি জানা যায়নি।
পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে, বরগুনায় ইসিআরআরপির অধীনে বাস্তবায়িত কাজের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধেও অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বরগুনা জেলার সদর উপজেলার নিশানবাড়িয়া এলাকায় ৪২ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের জন্যে সাড়ে ৯ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকলেও সেখানে ৫ কোটি টাকার কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। বাকী টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। অভিযোগকারীদের মতে, স্পেসিফিকেশান অনুসারে এসব বেড়িবাঁধের গড় উচ্চতা ১১ ফুট হওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়েছে ৯ ফুটের কম। অভিযোগকারীদের মতে, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তিনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ১৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার কাজ পায়। এই কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর পয়েন্টে ৫ কিলোমিটার ২০ মিটার, ধানখালীর দেবপুর পয়েন্টে ৫ কিলোমিটার ৫০ মিটার, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ৪৬ পোল্ডারের নীলগঞ্জে ১২ কিলোমিটার ৭০ মিটার এবং রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোট বাইশদিয়া গ্রামের ৫২/৫৩-এ পোল্ডারে ৭ কিলোমিটার ৯০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার এবং সøুইস গেট নির্মাণ করে যা দাপ্তরিক নথি অনুযায়ী ৩১ মার্চ, ২০১৩ তারিখে সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রদর্শিত হয়। এ সব কাজ নিম্নমানের হওয়ায় জোয়ারে বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং সিসি ব্লক যথাযথভাবে ব্যবহার না হওয়ায় বাঁধ নিধ্বস্ত হয়।
অপরদিকে, পাউবো’র ইসিআরআরপি প্রকল্পের টাকার অপচয় করে মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পের অনেক কর্মকর্তাই অস্ট্র্রেলিয়া, স্পেন, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করে বেড়িয়েছেন। ইসিআরপি প্রকল্পের মহাপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম স্পেন, অষ্ট্রেলিয়া ও নেপালে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি স্পেনে কাটিয়েছেন ৮ দিন, অষ্ট্রেলিয়ায় ৯ দিন এবং নেপালে ৬ দিন। প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রৌফ প্রকল্পের বিনোদন সফর করেছেন ভারত ও থাইল্যান্ডে। তিনি ভারতে ১১ দিন এবং থাইল্যান্ডে ১৮ দিন প্রমোদ ভ্রমন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে, পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ থাইল্যান্ডে প্রমোদ ভ্রমন করেছেন ৭ দিন। উপ-পরিচালক শামীম খান ৯ দিন অস্ট্র্রেলিয়ায় ভ্রমন করেছেন। অপর উপপরিচালক মো. খায়রুল হাসান থাইল্যান্ডে ১৮ দিন বিনোদন সফরে ছিলেন।
পাউবো’র দুর্নীতিবাজদের ফিরিস্তি লিখলে দুর্নীতির মহাকাব্য রচনা করা যাবে। এগুলো লিখে কোন কাজই হবে না যদি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত না হয়। টাস্কফোর্সের কথিত স্কচটেপ খুলে দিলেও পত্র-পত্রিকায় অধিকতর তথ্য প্রকাশিত হতে পারে। সেদিক থেকে টাস্কফোর্সের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া যায় কি না তাও ভেবে দেখা দরকার। অভিজ্ঞমহল এ ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুদুক, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।