পাঞ্জেরী ডেস্ক
আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত মহীয়সী নারী মাদার তেরেসার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার। ১৯৯৭ সালে আজকের এ দিনে মারা যান তিনি। মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬ অগস্ট অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইউস্কুবে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২৬ অগস্ট জন্ম হলেও তিনি ২৭ অগস্ট তারিখটিকে তার ‘প্রকৃত জন্মদিন’ মনে করতেন। কারণ ওই তারিখেই তার ব্যাপটিজম সম্পন্ন হয়েছিল।
মাদার তেরেসা নিকোলো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। তাদের আদি নিবাস ছিল আলবেনিয়ার শকড্যর অঞ্চলে। মাদার তেরেসার পিতা আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন।
জোয়ান গ্র্যাফ ক্লুকাস রচিত জীবনী থেকে জানা যায়, ১২ বছর বয়সেই মাদার তেরেসা ধর্মীয় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায় যোগ দেন। মা আর দিদিদের সঙ্গে মাদার তেরেসার আর কোনোদিন দেখা হয়নি।
১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’ নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন। সেই সঙ্গে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিকাশ ও উন্নয়নেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই মিশনারি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের চূড়ান্ত প্রতিকূল সময়ে মাদার তেরেসা যুদ্ধের একেবারে ফ্রন্ট লাইনের হাসপাতালে আটকে পড়া ৩৭ শিশুকে উদ্ধার করেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও ফিলিস্তিনী গেরিলাদের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়ে পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে এনেছিলেন। এই সুযোগেই রেড ক্রসের সহায়তায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে যান তিনি। বিধ্বস্ত হাসপাতালগুলো থেকে কম বয়সের রোগীদের সরিয়ে আনেন।
সমাজতান্ত্রিক শাসনের সময়ে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশেই মিশনারি কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৮০-’র দশকে ইউরোপের সে অংশ তুলনামূলক উদার হয়ে উঠে। এ সময়েই মাদার তেরেসা মিশনারিজ অফ চ্যারিটির কাজ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। কয়েক ডজন প্রকল্পের মাধ্যমে তার কাজ শুরু হয়েছিল। এ সময় গর্ভপাত এবং বিবাহবিচ্ছেদ-এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কারণে অনেকে তার সমালোচনা করেন। কিন্তু তেরেসা সব সময় বলতেন, ‘নো ম্যাটার হু সেইজ হোয়াট, ইউ শুড অ্যাকসেপ্ট ইট ইউথ এ স্মাইল অ্যান্ড ডু ইউর ওন ওয়ার্ক’।
মাদার তেরেসা ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্তদের কাছে যেতেন, ভ্রমণ করতেন চেরনোবিল বিকিরণে আক্রান্ত অঞ্চলে। আমেরিকার ভূমিকম্পে আক্রান্তদের মাঝে সেবা পৌঁছে দিতেন। ১৯৯১ সালে মাদার তেরেসা প্রথমবারের মতো মাতৃভূমি তথা আলবেনিয়াতে ফিরে আসেন। এদেশের তিরানা শহরে একটি “মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ব্রাদার্স হোম” স্থাপন করেন।
১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০ টিরও বেশি দেশে মোট ৫১৭টি মিশন পরিচালনা করেছিলেন। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০টি কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিলেন। গরিবদের মধ্যেও যারা গরিব তাদের মাঝে কাজ করতো এই চ্যারিটি। এখনও করে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চ্যারিটির প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্ক্স বরোর দক্ষিণাঞ্চলে। ১৯৮৪ সালের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে চ্যারিটির প্রায় ১৯টি শাখা সক্রিয়ভাবে কাজ করা শুরু করে।
চ্যারিটি দাতব্য কাজের জন্য যে অর্থ পেতো তার ব্যবহার নিয়ে বেশ কয়েকজন সমালোচনা করেছেন। ক্রিস্টোফার হিচেন্স ও স্টার্ন সাময়িকী সমালোচনা করে বলেছে, গরীবদের উন্নয়নের কাজে চ্যারিটিতে যত অর্থ আসে তার কিছু অংশ অন্যান্য কাজেও ব্যয় করা হয়।
১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোটগ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করেন। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তার বাম হৃৎপিণ্ডের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ওই বছরেরই ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন মানব সেবায় নিয়োজিত এ মহান নারী। তার মৃত্যুর পর পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে স্বর্গীয় আখ্যা দেন; এবং তিনি কলকাতার স্বর্গীয় টেরিজা (Blessed Teresa of Calcutta) নামে পরিচিত হন।
মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিজ অফ চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার, এর সাথে ৩০০ জন ব্রাদারহুড সদস্য ছিল। আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১ লাখেরও উপর। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০টা মিশনের মাধ্যমে চ্যারিটির কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এসব মিশনের মধ্যে ছিল এইডস, কুষ্ঠরোগ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, সুপ কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়।
এ মহীয়সী নারী নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৭৯), ভারতরত্ন (১৯৮০), প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম (১৯৮৫) ও বালজান পুরস্কার (১৯৭৮) লাভ করেন।